ক্যাটাগরি

মূল্যস্ফীতি: জীবন টেনে নেওয়ার লড়াই এখন কোথায় কেমন

মহামারী আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এর আগে শস্যের ফলনে দেখা দিয়েছিল টান। তার মধ্যে ইউক্রেইনে যুদ্ধ বাঁধলে সরবরাহ শৃঙ্খল বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ায় বিশ্বজুড়ে খাদ্য পণ্য ও জ্বালানির দামের অব্যাহত বৃদ্ধিতে ভুগছে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ।

বিশ্ব ব্যাংক সতর্ক করেছে, ইউক্রেইনে সামরিক অভিযানের জেরে মস্কোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবরোধ, রাশিয়ার গ্যাস কেনা বন্ধের সিদ্ধান্ত এবং সারের উচ্চ মূল্য আরেকটি মন্দার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে।

এই সঙ্কটের প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়েই। আর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিভিন্নভাবে তা মোকাবেলা করে টিকে থাকতে চাইছে। এর মধ্যে ধনী দেশ যেমন রয়েছে, তেমনি গরিব দেশও রয়েছে।

সংগ্রামের এই আঞ্চলিক চরিত্র বোঝার চেষ্টা করেছে বিবিসি; তাতে দেখা গেল কেউ খরচ কমিয়ে, কেউ অন্য খরচ কাটছাঁট করে চলছে, কেউবা দেশ ছেড়ে পালানোর পথও বেছে নিচ্ছে।

ব্রাজিল: মাঠে শস্য, কিন্তু ঘরে খাবার নেই

রোজিয়ান ইনাসিও বুলহোয়েস দে অলিভিয়েরার জন্য এখন নিত্যপণ্য কেনাও দায়। সাও পাওলোর আরারাকুয়ারার এই বাসিন্দা চার সন্তানের মা। এখন তিনি মূল্যছাড়ের কুপন আর সস্তা মুদি দোকানের উপর নির্ভর করছেন।

খালি ফ্রিজটি খুলে বিবিসির প্রতিবেদককে দেখান যে সেখানে শুধু আধখাওয়া একটি খাবারের পাত্রই রয়েছে।

তা দেখিয়ে অলিভিয়েরা বলেন, “আমার বস এই খাবারগুলো ফেলে দিচ্ছিলেন, আমি সময়মতো উপস্থিত হওয়ায় এগুলো রক্ষা পেয়েছে।”

গত বছর ব্রাজিলে নিত্যপণ্য ও সেবা খাতের মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কে পৌঁছায়।

কৃষিতে বিশ্বের অন্যতম ‘পাওয়ার হাউজ’ হওয়ার পরও এখন ব্রাজিলে প্রতি চারজনে একজন পেটপুরে খেতে পাচ্ছে না। সেদেশে খাদ্যের দাম যে গতিতে বাড়ছে, তার সঙ্গে তালমিলিয়ে নাগরিকদের বেতন বা আয় বাড়ছে না।

মহামারীর কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন আর জলবায়ু পবিরর্তনের প্রভাব ও সারের দাম বাড়ায় কৃষকের শস্য উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে, যা ভোক্তা পর্যায়ে বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে।

অলিভিয়েরার বাড়ির ভেতরে একটা বাজে গন্ধ, যা প্রমাণ করছে বাড়ি পরিচ্ছ্ন্ন রাখাও এখন তার জন্য বাড়তি খরচ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রান্নার তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় অলিভিয়েরা ও তার বাবা একটা দারুণ উপায় বের করেছেন, তা হল ব্যবহার করা তেল দিয়ে সাবান তৈরি করা।

নিউ জিল্যান্ড: খরচের ধাক্কায় দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায়

জমি বা স্থাপনা কেনার বিবেচনায় নিউ জিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটন বিশ্বে দামি শহরের একটি। যারা বাড়ি বা স্থাপনা ভাড়া দিয়ে থাকেন, তাদের জন্য পরিস্থিতি সুখকর না, কারণ গত বছর এই খাতে দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। এর সঙ্গে পেট্রল আর খাদ্য পণ্যের দাম বেড়ে চলায় স্থানীয় অনেকেই পাশের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন, সেখানে তাদের বসবাস ও কাজ করার অনুমোদন আছে।

নির্মাণ কর্মী ও ক্রিস ও তার জীবনসঙ্গী হারমোনি তাদের চার মেয়েকে নিয়ে সম্প্রতি ওয়েলিংটন ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন শহরে ঠিকানা করেছেন। ওয়েলিংটনে নিজেদের বাড়ি এবং ভালো আয় থাকার পরেও সেখানে তাদের চলতে কষ্ট হচ্ছিল।

ক্রিস বলেন, “আমাদের চার সন্তান, তাই সেখানে খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আমরা এখানে আসার পর খেয়াল করেছি যে অস্ট্রেলীয়রাও বলছে যে জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে। অথচ নিউ জিল্যান্ডে পাঁচ বছর আগেই এই খরচের সীমা পার করে এসেছি আমরা।”

নিউ জিল্যান্ড এবং সেখানে নিজের স্বজনদের ছেড়ে আসা কঠিন এক সিদ্ধান্ত ছিল হারমোনির জন্য। কিন্তু তিনি জানালেন, সন্তানদের স্বার্থেই এই স্থানান্তর দরকার হয়ে পড়েছিল।

তিনি বলেন, “নিউ জিল্যান্ডে আপনি আয় করতে পারবেন না। সেখানে জীবিকা অর্জনের কোনো পথ নেই। আপনি শুধু পেছনেই যাবেন। আপনি যদি বসবাস করে যেতে চান, সেখানে আপনার জন্য কোনো বিকল্প নেই। হয় আপনাকে বের হয়ে যেতে হবে, নয়ত নিউ জিল্যান্ডকে বদলাতে হবে। আমি সন্তানদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখতে চাই, কিন্তু নিউ জিল্যান্ডে তা নেই।”

নিউ জিল্যান্ডের সরকার নাগরিকদের বোঝা কমাতে জ্বালানিতে ভর্তুকি ও গণপরিবহনের ভাড়া অর্ধেক করে দেওয়ার মতো কিছু স্বল্প মেয়াদী উদ্যোগ নিলেও অনেকের জন্যই তা যথেষ্ট নয়।

ইতালি: জ্বালানির খরচ দ্বিগুণ হওয়ায় পেটে টান

ইতালির ব্রেসিকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ধমনীতে বইছে ইস্পাত। গত ১৫ বছরে সেখানে এই ইস্পাত খাতের উপর ভর করে আর্থিক মন্দা আর কোভিড মহামারীর ধাক্কা সামলেছে সেখানকার বাসিন্দারা, এখন ইউক্রেইনে যুদ্ধ আর চীনে লকডাউনের কারণে বাণিজ্য পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠেছে। মিরেলা আর লুকাসের দেখা মিলল ব্রেসিকার একটি ফাউন্ড্রিতে। তাদের দুজনের মজুরিকে ছাপিয়ে গেছে খাদ্য, পেট্রল আর জ্বালানির খরচ।

মিরেলা বলেন, “বিদ্যুতের কথাই ধরুন, আর সবার মতো আমরাও ভুগছি। আমাদের বিদ্যুৎ বিল দ্বিগুণ বেড়েছে, অথচ আমরা বলতে গেলে বাড়িতে থাকিই না। আমরা কষে কোমরের বেল্ট বাঁধছি। অনেক বেশি সঞ্চয়ের চেয়ে আপনি এখন কমই সঞ্চয় করতে পারবেন।”

এই ফাউন্ড্রিতে পণ্যের ক্রয়াদেশ নিয়মিতই আছে। কিন্তু পণ্য উৎপাদনের কাঁচামালের সরবরাহে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কারণ এই কারখানার দরকারি ধাতুর সরবরাহ আসত ইউক্রেইনের দক্ষিণ-পুবের মারিউপোল থেকে। রুশ সেনারা ওই শহর দখলের পর সরবরাহ থেমে গেছে।

ঘানা: পানির খরচ কেটে নিচ্ছে সাপ্তাহিক বাজেট

ঘানায় একটি খাবার সরবরাহের ব্যবসা পরিচালনা করেন মার্ক ইম্পরাইম। আফ্রিকার অন্যতম ব্যয়বহুল এই দেশে তিনি তার সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারের অন্যতম উপকরণ – জোলোফ চাল – এখন দ্বিগুণ দামে কিনছেন। আর তা দ্বিগুণ হয়েছে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে।

স্থানীয় একটি দোকানে পণ্যের তাকে লেখা দাম দেখিয়ে মার্ক বললেন, “টমেটো কয়েক মাস আগেও ২০ সেদিস (স্থানীয় মুদ্রা) ছিল, এখন দাম ৪০ সেদিস। তাই আমি যে খাবার সরবরাহ করি, সেটার দামও স্বাভাবিকভাবেই দ্বিগুণ করা উচিৎ। কিন্তু কিন্তু তাতে তো আমি ক্রেতা হারাবো। বরং আমি ভিন্ন পথ নেওয়ার চেষ্টা করব, হয়ত পরিমাণ কমিয়ে দেব।”

মার্কের সাপ্তাহিক বাজেটে অন্যান্য পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছে খাওয়ার পানির খরচ। গত চার মাসে দুইবার ডলারের বিপরীতে সেদির অবমূল্যায়ন হওয়ায় পানির দাম বেড়ে গেছে।

থাইল্যান্ড: সারের দামে হুমকিতে চাল রপ্তানি

মৌসুমী বৃষ্টিপাতের কারণে ক্ষেতের জমি নরম থাকায়, থাইল্যান্ডের ধানচাষি বুনচুয়াই সোমসুক ও তার প্রতিবেশীরা এখন জমিতে সার ছিটাচ্ছেন। রাজধানী ব্যাংককের উত্তরে সুফানবুরি অঞ্চলের থাই চালের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় এই চাল রপ্তানি করা হয়।

বুনচুয়াইয়ের একটি নোটবুক আছে যেখানে তিনি তার ঋণের হিসাব রাখেন। সেটা দেখে বিবিসিকে তিনি জানান, এখনও গত বছরের ৪০০ পাউন্ডের সমপরিমাণ দেনা শোধ করতে হবে তাকে।

বিশ্ব বাজারে চালের দাম কম, অথচ সারের দাম বেড়ে চলেছে। ফলে এই বছরের ফলন বিক্রি করেও আগের বছরের দেনা শোধ করার সম্ভাবনা খুব একটা দেখছেন না থাই এই কৃষক।

গত এপ্রিলেও দেশটিতে সার বিক্রি হয়েছে ৫৫০ বাথে (স্থানীয় মুদ্রা), কিন্তু এ বছর একই সার তিন গুণ দামে কিনতে হচ্ছে তাকে। থাইল্যান্ড সার উৎপাদনের ৯০ শতাংশ উপকরণই আমদানি করে থাকে।

বৈশ্বিক বাজারের চেয়ে দাম কম রাখতে থাই সরকার সারের দামে সীমা বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু উৎপাদনকারীরা বলছে, এটা টেকসই পথ না কারণ তারা লোকসান গুণছেন।

পর্যাপ্ত রপ্তানির জন্য অতিরিক্ত ধান-চাল ফলাতে থাই কৃষকদের বিপুল পরিমাণ সার দরকার। ধানের ফলন ঠিক রাখতে হয় সারের দাম কমাতে হবে, নয়ত চালের দাম বাড়াতে হবে।

আর চালের দাম বাড়ালে তা অন্য অনেক দেশের জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।