বুধবার সকালে ভারতের নিউ জলপাইগুড়ি (শিলিগুড়ি) স্টেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর ঢাকার পথে রওয়ানা হচ্ছে আন্তঃদেশীয় যাত্রীবাহী ট্রেন ‘মিতালী এক্সপ্রেস’।
ট্রেনটি ভারতের হলদিবাড়ি স্টেশনে ১০ মিনিটের যাত্রাবিরতি দেবে। আর বাংলাদেশের চিলাহাটিতে চালক পরিবর্তনের জন্য থামবে আধা ঘণ্টা। এ ছাড়া আর কোনো বিরতি নেই। ট্রেনের ওয়াটারিং ও ক্লিনিং হবে ঢাকা স্টেশনে।
রেলওয়ে জানিয়েছে, চিলাহাটিতে থামলেও সেখানে কোনো যাত্রী উঠতে পারবেন না। তাদেরকে ঢাকা থেকেই ট্রেনে চড়তে হবে। আর টিকিট কাটতে হবে ঢাকা বা চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে। ট্রেনের আসন বিণ্যাসও হবে সেখান থেকেই।
১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া এই রেলপথ চালুর জন্য চিলাহাটিবাসী দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছেন। ৫৫ বছর পর ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের ভার্চুয়াল দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলনে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে এই রেলপথ উদ্বোধন করেছিলেন। এর সাড়ে সাত মাস পর গেল ১ অগাস্ট শুরু হয় পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল। তার ১০ মাস বাদে চালু হচ্ছে যাত্রীবাহী ট্রেন।
রেলওয়ে নীলফামারীর চিলাহাটি স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার মো. ময়নুল হোসেন বলেন, “আপতত চিলাহাটি স্টেশনে টিকিট বিক্রি এবং আসন বরাদ্দের কোনো নির্দেশনা পাইনি। আপনারা টিকিট সংগ্রহ করতে পারবেন চট্টগ্রাম এবং ঢাকা স্টেশন থেকে।”
“এ স্টেশনে ইমিগ্রেশন বা আদার্স কোনো কর্মকাণ্ড হবে না। সীমান্ত স্টেশন হওয়ায় ট্রেনটি এসে দাঁড়াবে এবং প্রয়োজনীয় কাজ শেষে ভারতের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।”
রেলওয়ে জানায়, নিউ জলপাইগুড়ি থেকে প্রতিদিন পৌনে ১২টায় ছেড়ে ট্রেনটি বাংলাদেশে পৌঁছাবে রাত সাড়ে ১০টায়। ফিরতি যাত্রায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে রাত ৯টা ৫০ মিনিটে রওনা হয়ে পরদিন ভারতীয় সময় ৭টা ১৫ মিনিটে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছাবে। যাত্রীদের ইমিগ্রেশন কার্যক্রম দুই স্টেশনেই সম্পন্ন করা হবে।
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হাফিজুর রহমান প্রামাণিক বকুল বলেন, “দীর্ঘ ৫৭ বছর পর যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের খবরে আমরা আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। কিন্তু ঠিক এ সময় আমরা আরও একটি খবর পেয়ে হতবাক ও আশাহত।
“আমাদের এই চিলাহাটি স্টেশন থেকে মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে কেউ ভারতে যেতে পারব না। কেউ যদি ভারতে যেতে চান তবে তাকে চিলাহাটি কিংবা নীলফামারী জেলা থেকে ৪০০ কিলোমিটার পারি দিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে গিয়ে মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়তে হবে। তারপর আবার চিলাহাটি হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি যেতে হবে। এমন সিদ্ধান্তে আমাদের নীলফামারীর চিলাহাটি তথা রংপুর বিভাগের আট জেলার মানুষ হতাশ।”
চিলাহাটি বাজারের ব্যবসায়ী এ কে এম জাহাঙ্গীর বসুনিয়া রাসেল মনে করেন, এই ট্রেনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেও তারা বঞ্চিত। ভারতে ভ্রমণের জন্য তিনি পাসপোর্ট-ভিসাও নিয়েছেন। কিন্তু চিলাহাটি থেকে উঠতে পারবেন না জেনে তিনি হতাশ।
“আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে অথচ আমরা সেই ট্রেনে চড়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারছি না। এটা অনেক কষ্টের।”
ডোমারের আব্দুর রউফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমিনুর রহমান বাপী বলেন, “চিলাহাটি-হলদিবাড়ি যাত্রীবাহি ট্রেন চলবে শুনে আনন্দে পাসপোর্ট ও ভিসা করেছি। চিলাহাটির স্টেশন মাস্টার জানালেন, এই স্টেশনের জন্য কোনো আসন কিংবা টিকিট বরাদ্দ নেই। এখন থেকে কেউ ট্রেনে চড়তে পারবেন না। এটি জানার পর থেকেই আমি মর্মাহত।”
ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আজাদুল হক প্রামাণিক। তিনি একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক।
তিনি বলেন, “চিলাহাটিতে ইমিগ্রেশন ভবন, আন্তর্জাতিকমানের স্টেশন না থাকায় আমরা এই স্টেশন থেকে যেতে পারছি না। আমরা চাই, দ্রুত চিলাহাটিতে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু করে এই স্টেশনের জন্য আসন এবং টিকিট বরাদ্দ দেওয়া হোক।”
নীলফামারী জেলা ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও জেলা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ সরকার বলেন, “অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর এ পথে যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হচ্ছে। আমাদের আশা ছিল, ট্রেন চালুর প্রথম দিন থেকে চিলাহাটি থেকে এলাকার মানুষ ভারতে চলাচল করতে পারবে। কিন্তু চিলাহাটিতে যাত্রী উঠা-নামার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আমরা নিরাশ হয়েছি।
“তবে আমরা আশাবাদী, প্রধানমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রী দ্রুততম সময়ে আমাদের দাবি বিবেচনা করবেন। পাশপাশি ট্রেন সিডিউল বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি। কারণ চিলাহাটি থেকে ভারতের উদ্দেশে ভোরে ট্রেনটি ছেড়ে যাবে। তাতে এ এলাকার মানুষের জন্য রাতে ওই স্টেশনে উপস্থিত হওয়া অনেক কষ্টকর হবে।“
তিনি আরও জানান, এ এলাকার ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ এখন ভারতে চলাচল করে ১০০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাবান্ধা অথবা বুড়িমারী স্থলবন্দর হয়ে। এতে অনেক অর্থ ও সময় অপচয় হয়।
এ ব্যাপারে নীলফামারীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, “আপতত ট্রেনটি নিউ জলপাইগুড়ি ও ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের মধ্যে চলাচল করবে। চিলাহাটিকে পরিপূর্ণ স্থলবন্দর হিসেবে রূপায়িত করার জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
“কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এরই মধ্যে আমরা কথা বলেছি, আমরা আশা করছি, খুব দ্রুত নীলফামারীর চিলাহাটি থেকে বাংলাদেশের জনগণ ভারতে এবং ভারতের জনগণ এখানে চলাচল করতে পারবেন। ভবিষ্যতে আমরা অবশ্যই চিলাহাটিতে স্টপেজ পাব।”
রেলওয়ের উপ পরিচালক (ইন্টারচেঞ্জ) মিহরাবুর রশিদ খাঁন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মিতালী এক্সপ্রেসে মোট ৪০৮টি আসন রয়েছে। এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চারটি বার্থ/সিট কোচ ও চারটি চেয়ার কোচ থাকছে।
এসি বার্থের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৪ ডলার। তবে ১৫% ভ্যাট, ৫০০ টাকা ট্রাভেল ট্যাক্স, ২০০ টাকা বেডিং ভাড়াসহ এ শ্রেণির প্রতি আসনের টিকেট কাটতে গুনতে হবে পাঁচ হাজার ২৫৫ টাকা।
এসি সিটের ভাড়া ধরা হয়েছে ৩৩ ডলার। ১৫% ভ্যাটসহ এ শ্রেণির টিকেট মিলছে তিন হাজার ৪২০ টাকায়।
আর এসি চেয়ার শ্রেণিতে ভাড়া ধরা হয়েছে ২২ ডলার। ১৫% ভ্যাট ও ৫০০ টাকা ট্রাভেল ট্যাক্সসহ ২৭৮০ টাকায় এ টিকেট মিলছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
৫ বছর বয়স পর্যন্ত বয়সীদের ক্ষেত্রে ভাড়া হবে অর্ধেক। যাত্রার তারিখসহ ৩০ দিন আগে টিকেট কেনা যাবে।
ছয় মাস পর ডলারের মূল্যমানের উপর নির্ভর করে ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
রেল কর্মকর্তারা জানান, ট্রেনটি ভারতের হলদিবাড়ি স্টেশনে ১০ মিনিটের যাত্রাবিরতি দেবে। আর বাংলাদেশের চিলাহাটিতে চালক পরিবর্তনের জন্য থামবে আধা ঘণ্টা। এ ছাড়া আর কোনো বিরতি নেই। ট্রেনের ওয়াটারিং ও ক্লিনিং হবে ঢাকা স্টেশনে।
মিতালী এক্সপ্রেস ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তৃতীয় যাত্রীবাহী ট্রেন। মহামারীতে দীর্ঘ দুই বছর বন্ধ থাকার পর মৈত্রী এক্সপ্রেস ও বন্ধন এক্সপ্রেস গত রোববার আবার চালু হয়েছে।
ঢাকা-কলকাতার মধ্যে মৈত্রী এক্সপ্রেস প্রথম চালু হয় ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল। ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু ও লালন সেতু হয়ে দর্শনা-গেদে রুটে এই ট্রেন চলাচল করে সপ্তাহে পাঁচ দিন।
আর ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর খুলনা-কলকাতা রুটে বন্ধন এক্সপ্রেস চালু হয়। বেনাপোল-পেট্রাপোল রুটে সপ্তাহে দুই দিন চলাচল করে এটি।
আরও পড়ুন:
৫৫ বছর পর চিলাহাটিতে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রেন, চলবে নিয়মিত