গত পাঁচ বছরে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি মাত্র ৬৫ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে ১৬ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের ১০ কিলোমিটার অংশ খুলে দিতে চায় বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ।
এদিকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের কারণে ভাঙা রাস্তা, ধুলা আর বৃষ্টি হলে কাদা পানিতে চরম ভোগান্তিতে আছে নগরবাসী। নির্মাণ কাজের জন্য সড়কের বিভিন্ন অংশে সৃষ্ট যানজট সামাল দিতে নাকাল পুলিশের ট্রাফিক বিভাগও।
রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মেটাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে টোল বসানোরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টোল বসালে এ প্রকল্পের উপযোগিতা নষ্ট হবে এবং জনগণ সুফল থেকে বঞ্চিত হবে।
লাগবে আরও ২ বছর
২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক সভায় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকার এ প্রকল্প যখন অনুমোদন পায়, তখন তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল।
নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত চারলেইনের এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে ১৬ কিলোমিটার।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে কাজ শুরু হলেও ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিকতা সারেন।
কাজ শুরুর পর চট্টগ্রাম বন্দরের আপত্তি, জমি অধিগ্রহণের জন্য অপেক্ষা, ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি না পাওয়া, লালখান বাজার অংশের নকশা নিয়ে আপত্তি ও বিকল্প সড়ক চালু করতে দেরিসহ নানা কারণে প্রকল্পটি বিলম্বিত হয়।
শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জুন থেকে বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন করা হয়। তারপর আরও এক বছর বাড়ানো হয়। সবশেষ তা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক সিডিএ প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর প্রস্তাবটি সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। র্যাম্প-লুপসহ মোট ৩৯০টি পিলারের মধ্যে ৩০০টির বেশি পিলারের কাজ শেষ। আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মধ্যে আমরা পতেঙ্গা থেকে নিমতলা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার অংশ খুলে দিতে চাই। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে।”
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রকল্পটি গ্রহণের সময় সিডিএ এর তখনকার কর্তৃপক্ষের এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা ছিল না। এখন সক্ষমতা বেড়েছে।
“কিন্তু তড়িঘড়ি সংশ্লিষ্টদের সাথে সমস্যা সমাধান না করেই কাজ শুরু করায় নানা সমস্যার উদ্রেক হয়। কাজ চলমান অবস্থায় বিরোধ মেটানো ও এলাইনমেন্ট সংশোধন করতে হয়েছে।”
এতে করে দ্বিমুখী ক্ষতি হয়েছে মন্তব্য করে দেলোয়ার মজুমদার বলেন, “সঠিক অ্যাসেসমেন্ট করে কাজ শুরু না করায় এবং নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় খরচ বাড়ছে। সময়ও বেশি লাগছে। এতে জনগণের সুফল পেতে যেমন দেরি হচ্ছে, পাশাপাশি ভোগান্তিও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।”
প্রকল্পের ব্যয় আরও প্রায় ১৫০০ হাজার কোটি টাকা বাড়াতে সিডিএ এর দেওয়া প্রস্তাব এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি বলে জানান প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান।
ভোগান্তি চলছেই
প্রকল্পের ইপিজেড থেকে বন্দর টিলা বাজার পর্যন্ত সড়কের পূর্ব পাশে নালা সম্প্রসারণের জন্য আগে থাকা নালাটি কাটা হয়েছে। ইট, বালি, সিমেন্ট সব রাখা হয়েছে সড়কের ওপর।
ওই পথ ধরে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকার লাখ খানেক শ্রমিক আসা যাওয়া করেন। স্থানীয় বাসিন্দা আর শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি হচ্ছে ভাঙা রাস্তা আর কাদা-ধুলোর কারণে।
নেভি কলোনি বাজার সংলগ্ন স্থানীয় শারমিন ফার্নিচারের মালিক মো. রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চাইর বছর ধরে কাজ চলতেছে। ধুলাবালিতে দোকানে বসা যায় না। কাস্টমার আসবে কেমনে। এখন নালার কাজ শুরু হইছে। গত বর্ষায় তো কাদার কারণে দোকানে বেচাবিক্রিই হয়নি।”
এই পথ ধরে বন্দর টিলার দিকে সন্তানকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন সাইফুল হক। তিনি বললেন, “একপাশে ইট-বালু। বৃষ্টি হলে পুরো রাস্তা কাদা হয়ে যায়। আবার রাস্তাও ভাঙা। যে পরিমাণ বড় গাড়ি চলে, মেয়েকে নিয়ে হাঁটতেও ভয় হয়।”
স্থানীয়দের ভোগান্তির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, “গত বর্ষায় কাদাপানিতে মানুষ কষ্ট পেয়েছে। তাই এবার আসন্ন বর্ষার আগেই ওই অংশের নালার কাজ শেষ করতে কাজ চলছে।”
মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়িয়েছে ইপিজেডকেন্দ্রিক সকাল-সন্ধ্যার যানজট।
এই পথের নিয়মিত যাত্রী রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সন্ধ্যায় ইপিজেড মোড় থেকে সল্টগোলা মোড় পর্যন্ত গাড়ির জট লেগে থাকে রাত ৯-১০টা পর্যন্ত।
ইপিজেডের একটি কারখানার কর্মকর্তা অজয় মিত্র বলেন, “এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের জন্য ইপিজেড মোড়ে রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। লাখ লাখ শ্রমিক খুব কষ্ট করে প্রতিদিন এ পথে যাতায়াত করেন। চার বছরেও কাজ শেষ হল না।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি পুলিশকেও যে বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে, সে কথা বললেন নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (বন্দর) শাকিলা সুলতানা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পরিস্থিতি ম্যানেজ করা খুব কঠিন। বেশি গর্ত হলে আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বলে ভরাট করাই। এক সাথে ২-৩ জায়গায় কাজ ধরলে তখন তাদের বলে কোনো এক জায়গার কাজ বন্ধ রাখি।
“মানুষ কষ্ট করছে। আমরা চেষ্টা করি ভোগান্তি যত কমানো যায়। পিলারগুলোর কাজ শেষ হয়ে গেলে নিচের সড়ক কার্পেটিং করে দেওয়া যায়। আশা করি তিন মাসের মধ্যে পিলারের কাজ শেষ হবে।”
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আরেক অংশ ট্রাফিক বিভাগের পশ্চিম বিভাগের অধীনে। ওই বিভাগের উপ-কমিশনার তারেক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সড়কের এক তৃতীয়াংশ যদি নির্মাণ কাজে আটকে থাকে, তাহলে যান চলাচলের অংশ তো সরু হয়ে যায়। যানজট সামাল দিতে আমাদের কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যত দ্রুত কাজ শেষ হয় তত জনগণের জন্য ভালো।”
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা থেকে মাইলের মাথা পর্যন্ত অংশে গার্ডার বসানো হয়েছে। দেরিতে শুরু হওয়ায় বন্দর-কাস্টমস মোড় সংলগ্ন অংশে পিলার বসানোর কাজ চলছে।
বারিক বিল্ডিং থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত পিলার বসানো শেষ। দেওয়ানহাট রেলসেতুর পশ্চিম পাশ দিয়ে পাহাড় ঘেষে টাইগার পাস মোড়ের পর মূল সড়কের ওপর দিয়ে লালখান বাজার মোড় পেরিয়ে ওয়াসার মোড়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে মিলে শেষ হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
থাকবে টোল
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের রক্ষণাবেক্ষণে মাসে ২০ লাখ টাকার খরচ মেটাতে টোল ধার্য করা হবে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, “টোল না হলে এত খরচ মেটানো সম্ভব না। ১২টি টোল প্লাজা হবে।”
তবে প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার টোল বসানোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না।
“প্রকল্প গ্রহণের সময় তখনকার সিডিএ কর্তৃপক্ষ টোলের বিষয়টি জনগণের কাছে আড়াল করার চেষ্টা করেছে। প্রথমেই অভিযোগ উঠেছিল অল্প কিছু মানুষের জন্য এত বিশাল অংক খরচ করে এ প্রকল্প করা হচ্ছে। এখন তা সত্য হতে চলেছে।
“টোলের কারণে মানুষ এটা ব্যবহারে উৎসাহিত হবে না। ফলে মূল সড়কে যানজট থেকেই যাবে। টোল যদি বসাতেই হয়, তা এমন হতে হবে, যেন জনগণের ব্যবহারের সামর্থ্যের মধ্যে থাকে। সবচেয়ে ভালো হয় অন্য কোনোভাবে যদি খরচ সংস্থান করা যায়।”
আরও পড়ুন
চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: প্রকল্প বিলম্বিত, দুর্ভোগও দীর্ঘায়িত
চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়েসহ ছয় প্রকল্প উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী