ক্যাটাগরি

‘স্বয়ম্ভর’ বাংলাদেশের লক্ষ্য বাজেটে চান ফরাসউদ্দিন

আগামী ৯ জুন ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। তার আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে এ বিষয়ে নিজের ভাবনা তুলে ধরেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালনকারী ফরাসউদ্দিন মনে করেন, দেশকে আমদানিনির্ভরতা থেকে বের করে আনতে পারলে অর্থনীতির উপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বের হওয়া যাবে। আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে বাংলাদেশ।

“বঙ্গবন্ধু ম্যাক্রো ইকোনোমিক্স ম্যানজম্যান্ট এর যে তিন-চারটা কথা বলেছেন, প্রথম কথাটাই হচ্ছে, আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। স্বয়ম্ভর অর্থনীতি করতে হবে।”

শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উপর আস্থা প্রকাশ করে ফরাসউদ্দিন বলেন, “তিনিই পারবেন। তাকে শুধু এখনকার বাস্তবতার নিরিখে যারা কথা বলবে, তাদের কথাগুলো তাকে শুনতে হবে, তোষামোদের স্থান থাকা উচিত না। তোষামোদকারীরা প্রকৃত ছবিটা দেয় বলে মনে হয় না।”

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই আগের পুরো অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি আমদানি করেছে বাংলাদেশ।

জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫৮ বিলিয়ন ডলার। গত পুরো অর্থবছরে যা ছিল ৫৪ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।

এর ফলে বাংলাদেশের রিজার্ভের উপর চাপ পড়েছে। গত বছর রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার হলেও বর্তমানে কমে ৪২ বিলিয়নের ঘরে নেমে এসেছে। এর প্রভাব পড়েছে গোটা অর্থনীতিতে।

‘বড় বাধা খেলাপিরা’

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বাংলোদেশের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা কর খেলাপি, ঋণ খেলাপি এবং অর্থপাচারে জড়িত ব্যক্তিরা।

আসন্ন বাজেটে কর আহরণ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে।”

বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য দিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, এই দেশে আড়াই কোটি মানুষ আছে, যাদের বছরে আয় কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা।

দেশে আয়কর আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির ৩ লাখ টাকার বেশি বার্ষিক আয় হলে কর দিতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তাদের সবার কর দেওয়া উচিৎ।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, “আমার করদাতাদের বোঝাতে হবে, কর দিলে তাদের কী লাভ হবে। দেশের কী লাভ হবে, দেশের কী উন্নতি হবে।

“কিন্তু কিছু লোক আছেন যারা জেনে বুঝে কর দিচ্ছেন না। তারা মনে করছেন কর না দিলেও চলছে এবং চলবে।”

নিজের মত তুলে ধরে তিনি বলেন, “কর খেলাপি, ঋণ খেলাপি, মানি লন্ডারিং এই তিনটা জিনিসকে আমাদের সরকার প্রধানের দৃষ্টিতে আনতে হবে। এরা হচ্ছে বাংলাদেশের ম্যাক্রো অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় বাধা।”

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কর আহরণের মাত্রা অনেক কম। কর জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। যেখানে ভারতে ২০ শতাংশের কাছাকাছি, নেপালে ২১ শতাংশ, পাকিস্তানে প্রায় ১৩ শতাংশ।

‘কর আহরণ বাড়াতে হবে’

ফরাসউদ্দিনের ভাষ্য, দেশকে ‘স্বয়ম্ভর’ করতে হলে কর আহরণ বাড়াতেই হবে। সেজন্য কর আহরণ ব্যবস্থাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।

“গ্রামে গঞ্জে এখন ২০ লাখ, ২৫ লাখ এবং ১ কোটি টাকার মানুষ অনেক আছে কিন্তু তারা কিন্তু করের আওতায় নাই। এভাবে তো চলবে না। মুহিত সাহেবের একটা প্রস্তাব ছিল যে, করের অফিসগুলোকে বাইরে নিয়ে যাবেন তো এইটা অবিলম্বে করা দরকার।”

কর আদায় বাড়িয়ে সেখান থেকে দেশে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

“নতুন করদাতাকে সনাক্ত করে কর জালের মধ্যে আনাটা খুব দরকার, এটা সম্ভব। আমার ২৫ লাখ করদাতা থেকে আমি যদি আগামী ৫ বছরে এক কোটি করদাতায় নিতে পারি, তাহলে আমার কর জিডিপি রেশিও ১৫ হবে ১৯ হয়ে যাবে, যেটা নেপালের আছে এখন এভাবে করে আমি কিন্তু ইনভেস্টমেন্ট জিডিপি বাড়াব।”

‘বন্ধ করতে হবে দুর্নীতি-অর্থ পাচার’

ফরাসউদ্দিন মনে করেন, মানি লন্ডারিং, আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং স্টক মার্কেটে সো কল্ড প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশ থেকে অনেক টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে।

“বহু লোক দেশের বাইরে যাচ্ছেন ঈদের সময়, পূজার সময়। সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এরা যাচ্ছেন। আমাদের প্রাইভেট ইনফরমেশন হচ্ছে তারা কাড়ি কাড়ি ডলার নিয়ে যাচ্ছেন এবং মানি লন্ডারিং করছেন।

“ওই যে, আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং করেছে, রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং করেছে এবং স্টক মার্কেটে সো কল্ড প্লেসমেন্টের মাধ্যমে টাকা করেছে।”

এছাড়া বাংলাদেশে সঠিক দামে জমি নিবন্ধনের সুযোগ না থাকায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে উল্লেখ করে ফরাসউদ্দিন বলেন, “সবেচেয়ে বড় যেটা করাপশন, সেটা সরকারের পক্ষে রোধ করা একদম সম্ভব।

“এই যে ১০০ টাকার জমি রেজিস্ট্রেশন ২০ টাকার বেশি করা যায় না, সরকারই করে রাখেছে এই নিয়ম। এইখানে কিন্তু বিশাল দুর্নীতি হচ্ছে।”

এই ধরনের দুর্নীতি বন্ধ করতে এবং রাজস্ব আদায় বাড়াতে তিনি দুটি পথ বাতলে দিয়েছেন। জমি নিবন্ধনে একবারে বাজার মূল্যে জমির দাম ঠিক করা এবং ডলারের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো।

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

তিনি বলেন, “রেমিটেন্সের উপর যে অড়াই শতাংশ প্রণোদনা সেটার বেনিফিটটা পাচ্ছে মানি লন্ডাররা। তাই ৫ শতাংশ টাকা ডেপ্রিসিয়েশন করতে সেটা হলে, ওই যারা রেমিটেন্স পাঠান তারা কিন্তু বেশি টাকা পাবে।

“এই প্রণোদনার টাকা কিন্তু তারা পায় না। তাহলে তারা যদি ওই টাকাটা পায়, তাহলে তারা অবশ্যই টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাবে অসৎ পথে যাইতে হবে না।”

আমদানির চাপে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশের রেমিটেন্সে দেখা দিয়েছে ভাটার টান। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম রেমিটেন্স এসেছে।

জমি নিবন্ধনের বিষয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, “এছাড়া জমির মূল্যটা একবারে বাজারের মূল্য ঠিক করা, তাহলে সরকারের রাজস্ব বিপুল পরিমাণে বেড়ে যাবে।”

‘ডলারের দাম বাড়িয়ে লাভ’

এই অর্থনীতিবিদের মতে, ডলারের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশেকে ‘স্বয়ম্ভর’ দেশে পরিণত করার রাস্তা খোলা যাবে।

গত ১০ বছরে ভারত ডলারে বিপরীতে রুপির মান কমিয়েছে ৭০ শতাংশ, দেশে কমেছে ২২ শতাংশ। গত এক বছরে দেশে কমেছে ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ, ভারত ৬ দশমিক ৫ এবং পকিস্তান কমিয়েছে ৪৩ শতাংশ।                             

তিনি বলেন, “আমরা আমদানিনির্ভর দেশ, এটা শুনতে শুনতে ৫০ বছরে কান ঝালাপালা, কিন্তু আমি সবসময় বলেছি, এটাকে ইচ্ছে করে আমদানিনির্ভর করা হয়েছে। এতে দাতাদের সুবিধা হয়, ক্রেতাদের সুবিধা হয়।”

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

তার পরামর্শ, ডলারের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি করা পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিতে হবে। দেশে যেসব পণ্য তৈরি হয় সেসব যাতে আমদানি না হয় সেজন্য বড় ধরনের কর বসিয়ে দিতে হবে।

এছাড়া দেশে যাতে এই সব খাতে বিনিয়োগ হয় সেটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে জানিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, “বিনিয়োগ বাড়াতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি উদ্যোক্তাদের দিতে হবে বড় ছাড়।

“তাহলে দেশ আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসবে। আর দেশে হবে বঙ্গবন্ধুর দেখানো ‘স্বয়ম্ভর’ দেশ।”

ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানোর ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “৫ শতাংশ ডেপ্রিসিয়েশন করি তাহলে….আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু সেটাই দরকার।

“এটা করে, যে জিনিস আমি দেশে বানাই বানাতে পারি। যেমন- নির্মাণ সামগ্রী, ফার্নিচার, এই যে গুঁড়া দুধ, সাইকেল, মোটরসাইকেল, গাড়ি এগুলো সব আমি এখানে বানাব। আমদানি আমি একদম কঠিন করে দেব।

“আমার ফার্নিচারের জন্য, আমার গুঁড়া দুধ বানানোর জন্য, আমরা গাড়ি বানানোর জন্য বড় ধরনের সাপোর্ট আমি দেব।ওষুধের জন্য ম্যাসিভ সাপোর্ট আমি দেব। এগুলো করব, করলে আর আমদানিনির্ভর থাকব না।”

‘আমদানি কমাতে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে’

বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে ঋণ সহযোগিতা চুক্তির প্রসঙ্গ তুলে সেসবের আওতায় এখনও ছাড় না হওয়া অর্থ শিল্প খাতে ব্যবহারের কথা বলেন সাবেক এই গভর্নর।    

“আমার পাইপ লাইনে ৫০ বিলিয়ন ডলার আছে। আমাকে ৫০ বিলিয়ন ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাকে যে শিল্প এখানে করলে আমাদের আমদানি কমবে সেটা করতে হবে।

“বাংলাদেশ গত বছরের শেষ পর্যন্ত সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে ৯১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে। আরও ৫০ বিলয়ন ডলার যে কোনো সময় চাইলেই নিতে পারবে।”   

দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদন এবং রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্য দেশে যেসব বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে সেসব ব্যবহার করতে বলেন এই অর্থনীতিবিদ।

“এই যে ১০০টি বিশেষ অঞ্চল হচ্ছে ১০টি তো হয়ে যাচ্ছে। এখানে আমি যে শিল্পগুলোর কথা আমি বল্লাম, টেক্সটাইলসহ ম্যাসিভভাবে আমি জায়গা করে দেব এবং সব রকম সুযোগ-সুবিধা করে দেব।

“সেই যে আমদানিকারকদের কথা বল্লাম তারা আমদানি না করে দেশে করলে তাদের সুবিধা দেওয়া হবে, সুদের সুবিধা দেওয়া হবে।”

গাড়ির আমদানি নিরুৎসাহিত করার বিষয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশে গাড়ির ওপরে কাস্টমস ডিউটি অনেক দেশের তুলনায় কম, এজন্যই তো গাড়ি আসছেই আসছে, রাস্তা ভরেই যাচ্ছে। জায়গা পাওয় যাচ্ছে না, এগুলো খতিয়ে দেখা, তলিয়ে দেখার ব্যাপার আছে।”

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

কৃষিকে বাঁচাতে ও মানুষকে কম দামে খাদ্য দিতে সমবায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “কো-অপারেটিভ উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতি, এটা জাতির পিতা বলে গেছেন, গ্রামে গ্রামে সমবায় করব।

“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা বিশ্বাস করেন।এটা বৈষম্য দূর করার একটি অন্যতম প্রধান উপায়।”

ফরাসউদ্দিন বলেন, “কৃষক সমবায় সমিতি করে সাশ্রয়ী রেটে পাবে ঋণ। এই ঋণ দিয়ে তাদের জিনিসগুলো তারা কিনে গুদামজাত করবে সারা বছর, এটা রিলিজ করবে উৎপাদকরা, বেশি দাম পাবে, আমরা কম দামে কিনতে পারব।”

এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার খরচ কমাতে সড়ক পথে বিনিয়োগ না করে রেলে বিনিয়োগের পক্ষে মত দেন তিনি।

‘গরিবদের রক্ষা করতে হবে’

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে যারা দারিদ্র্য সীমার নিচে গেছে তাদের জন্য প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে তিন কোটি লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে। এটা যদি সাড়ে তিন কোটি হয় বা চার কোটি হয় তাহলে তো আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

“করোনাভাইরাসের কারণে কিছু লোকজন দারিদ্র্য সীমার নিচে গেছে, তাদেরকে ৯৮ সালে বন্যার সময় যেভাবে ভিজিএফ কার্ড দিয়ে দেড় কোটি মানুষকে নয় মাস খাওয়ানো হয়েছিল।

“তখন মাত্র ২ বিলিয়েন ডলার রিজার্ভ দিয়ে এত সমস্ত করা হয়েছে। তখন মূল্যস্ফীতি ছিল এক দশমিক সাত ভাগ। তখন যদি এটা করা যায় এখন করতে না পারার কোনো কারণ নেই।”