তবে একটা ভয় সঙ্গে নিয়েই তাকে প্যাডেল চালাতে হয়। রাস্তায় বেরিয়ে সুস্থভাবে ঘরে ফিরতে পারব তো?
শুক্রবার বিশ্ব সাইকেল দিবসে কথা হচ্ছিল নাজিফার সঙ্গে। কথায় কথায় সাইকেল নিয়ে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তিনি এই উদ্বেগের কথাও বললেন।
ঢাকায় যানজট আর গণপরিবহনের ঝক্কি এড়াতে অনেকেরই পছন্দ বাই সাইকেল, অনেকে তাতেই চলাফেরা করেন। কিন্তু সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা আর আলাদা লেইন না থাকায় সবসময় ঠিক স্বস্তির হয় না সেই যাত্রা।
নাজিফা বলছিলেন, “যখন রাস্তায় বের হই, আমার সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা হল বড় বড় বাস-ট্রাক। আমার কেবলই মনে হয়- এই বুঝি পেছন থেকে ধাক্কা দিল। আসলে এখানে কেউ তো নিয়ম মানে না।
“আমি যতই সেইফ থাকতে চাই, বাকিরা আমায় থাকতে দেয় না। তারা ধুমধাম ওভারটেক করার চেষ্টা করে, আর মেয়ে হওয়ায় তো কথাই নাই।”
ফাইল ছবি
কারিগরি কারণেই যে মোটরবাইকের সঙ্গে বাই সাইকেলের পাল্লা দেওয়া সম্ভব নয়, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “এই দুই বাহনই রাস্তার এক পাশ দিয়ে যাতায়াত করে। কিন্তু আপনি যদি স্পিডের (গতি) কথা ভাবেন, তখন বুঝবেন যে আমরা কতটা রিস্ক নিয়ে সাইক্লিং করি। বাইকারদের স্পিডের সাথে তো পাল্লা দিয়ে চলা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।”
এই সময়ে এসেও একটি মহানগরে সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন না থাকা ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মন্তব্য করেন নাজিফা।
গ্রামগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সাইকেলে চলাচল তুলনামূলক সহজ হলেও ঢাকায় নানা ভোগান্তির কথা উঠে এসেছে সাইক্লিস্টদের বয়ানে। তাদের স্বস্তি দিতে গত কয়েক বছরে দুটি স্থানে সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন হয়েছিল। সেসব এখন অন্যদের দখলে।
নাজিফার শঙ্কার প্রমাণ মিলেছে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এআরআই) পরিসংখ্যানে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তারা জানাচ্ছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে ঢাকা মহানগরে ৭৫০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে প্রাণ গেছে ৭৭৯ জনের।
ঢাকার এসব দুর্ঘটনার মধ্যে বাইসাইকেল দুর্ঘটনা ছিল ১৪টি, প্রাণ দিতে হয়েছে ১৩ জনকে। একই সময়ে সারাদেশে ২৫৯টি বাইসাইকেল দুর্ঘটনায় মোট ২৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে বাইসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা কম মনে হলেও এর ভয়াবহতা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
ফাইল ছবি
তবু সাইক্লিং বাড়ছে
কোভিড মহামারীর আগে ঢাকায় অপেক্ষাকৃত স্বস্তির সড়কে কার্যক্রম শুরু করে বাইসাইকেল রাইড শেয়ারিং কোম্পানি জোবাইক । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় জোবাইকের সেবা শিক্ষার্থী ও তরুণদের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে।
পরে তাদের সেবা বিস্তৃত হয়েছিল ঢাকার গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায়। আর ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কক্সবাজার শহরে এই সেবা চালু ছিল।
মহামারীর আড়াই বছরের দুঃসময় কাটিয়ে আগামী জুলাইয়ে এ কোম্পানি ফের কার্যক্রম শুরু করবে বলে জানালেন কোম্পানির সিইও মেহেদী রেজা।
তিনি বলেন, “যেহেতু জোবাইক মানেই ক্যাম্পাস, সেহেতু আমাদের সার্ভিসটি কন্টিনিউ করার অবস্থা ছিল না। কারণ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।
“আর লকডাউনের সময়টায় আমাদের প্রায় সাড়ে ৩০০ সাইকেল নষ্ট হয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১৪০টি আমরা মেরামত করতে পেরেছি, বাকি ২০০ সাইকেল পাকাপাকিভাবে ড্যামেজ হয়ে গেছে। তবে আমরা নতুন প্রায় ৫০০ সাইকেল নিয়ে আবার ব্যাক করবো।”
ঝুঁকি থাকলেও যানজটের কারণে ঢাকায় বাইসাইকেলের ব্যবহার বাড়ছে বলে জানালেন এ বাহনের দেশীয় ব্র্যান্ড দুরন্ত বাইসাইকেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার তৌহিদুজ্জামান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দেশে প্রতিবছর ২০ লাখ সাইকেলের চাহিদা রয়েছে। এর মাঝে ৪০ শতাংশ দেশে তৈরি হয়, বাকি ৬০ শতাংশ আমদানি করা হয়।
“প্রতিবছর বাংলাদেশে সাইকেলের চাহিদা ৮-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে, কারণ মানুষ এখন অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন, পরিবেশ সচেতন। আর ঢাকায় সাইকেল ব্যবহারের আরেকটা কারণ হল যানজটের সমস্যা।”
ফাইল ছবি
তবু গুরুত্ব পাচ্ছে না সাইক্লিং
কোভিডের বিধিনিষেধের কালে ঢাকায় সাইকেল ব্যবহারের প্রবণতা বেশি ছিল। তখন সড়কে অন্য যানবাহন কম থাকায় চলাফেরার সুবিধার জন্য সাইকেল বেশ জনপ্রিয়তা পায়। অনেকে বাসের ভিড় আর সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতেও বেছে নেন বাইসাইকেল।
কিন্তু সংক্রমণ কমে আসার পর সড়কে ফিরেছে সেই পুরনো বিশৃঙ্খলা। অনেকেই আবার সাইকেল তুলে রেখে আগের মত বাস বা অন্য বাহনে চড়ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ পরিবেশ না পাওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও অনেকে সাইকেল ব্যবহার করছেন না। আর বাহন হিসেবে সাইকেলকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, সংবাদমাধ্যমে দুর্ঘটনার খবর পরিবেশনের ধরনেও সেটা বোঝা যায়।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এআরআই) সহযোগী অধ্যাপক এস এম সোহেল মাহমুদ বলেন, “সাইকেল দুর্ঘটনার কথা সাধারণত পত্রপত্রিকায় সেভাবে আসে না। তাই দুর্ঘটনার বাস্তব চিত্রটা আরও বড়।”
দেশে এখন কত মানুষ সাইকেল ব্যবহার করে, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা কেউ জানি না যে সারাদেশে ঠিক কত বাইসাইকেল ব্যবহারকারী আছে। কারণ আমাদের দেশে সাইকেলের রেজিস্ট্রেশনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
“ব্যবহারকারীর হিসাব আমাদের কাছে না থাকায় সাইকেলের ট্র্যাফিক কম্পোজশিনটা আমাদের এখনও অজানা।”
পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে সাইকেলের পক্ষে প্রচার চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, আবাসিক এলাকা ও রিকশা লেইনগুলোকে সাইকেল ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার আহ্বান জানাচ্ছেন বুয়েটের এই শিক্ষক।
উন্নয়ন প্রকল্পে সাইকেল লেইনের বিষয়টি যে একেবারেই উপেক্ষিত থাকে, তা মনে করিয়ে দিয়ে বুয়েটের এআরআই পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, “আমরা যখন বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্প হাতে নিই, তখন বাইসাইকেল এবং সাইকেল লেইনের ব্যাপারে ভাবিই না। এটা আমাদের নীতি নির্ধারকদের কাছে কখনও প্রাধান্য পায়নি।
“অথচ ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার দূরত্ব কিন্তু খুব বেশি না। যারা প্রতিনিয়ত ঢাকার রাস্তায় চলাফেরা করেন, তাদের মাঝে অন্তত ৩০ শতাংশ লোকের গন্তব্য হয় দুই থেকে আড়াই কিলোমিটারের মাঝে। তাদের জন্য সাইকেলের চেয়ে ভালো বাহন আর কিছু হতে পারে না।”
কিন্তু ঢাকায় যে পরিমাণ রাস্তা, তার চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি যানবাহন এখানে চলে। ফলে মূল সড়কগুলোতে এখন আলাদা করে বাইসাইকেল লেইন করাটাও খুব কঠিন ব্যাপার বলে মনে করছেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।
বিশ্ব সাইকেল দিবস উপলক্ষে শুক্রবার সকালে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে হাতিরঝিল পর্যন্ত আয়োজন করা হয় সাইকেল শোভাযাত্রা।
নগর সংস্থার ভাবনায় কী?
গত কয়েক বছরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তরফ থেকে আগারগাঁও ও মানিক মিয়া এভিনিউয়ে সাইকেল লেন চালু করা হয়। কিন্তু এ দুটো লেইনের কোনোটিই সাইকেল চালকদের জন্য কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি বলে জানাচ্ছেন সাইক্লিস্টরা।
লেইন দুটি এখন অবৈধ পার্কিং আর হকারদের দখলে রয়েছে জানিয়ে সাইক্লিস্টদের সংগঠন বিডিসাইক্লিস্টসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফুয়াদ আহসান চৌধুরী বলেন, “এই সাইকেল লেইনগুলো শুধু ওই কাগজে কলমেই আছে, বাস্তবে এ দুটো আমাদের কোনো কাজে আসছে না।
“আগারগাঁওয়ের লেন তো কমপ্লিটই হয়নি পুরোপুরি। মানিক মিয়া এভিনিউয়ের লেইনের কথা আর কী বলব, উদ্বোধনের পর ওটা শুধু এক সপ্তাহ ঠিকভাবে চলেছিল।”
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বরাবরই সাইক্লিস্টদের জন্য সড়ককে নিরাপদ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। দুই সাইকেল লেইনের উদ্যোগে ব্যর্থতার কথা তিনিও মানলেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা এর আগে দুটো খুব সুন্দর সাইকেল লেইন তৈরি করেছি, কিন্তু সেগুলোতে এখন অবৈধ পার্কিং বিরাজ করছে। সেখানে ইঞ্জিনচালিত গাড়ি রেখে দেওয়া হয়েছে।
“এ সমস্যার জন্য আমরা কেবল মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পারি; কিন্তু আমরা এখানে পুলিশিং করতে পারি না। এজন্য জনগণকে বলতে হবে যে- না, সাইকেল লেইনের ওপর কোনো গাড়ি রাখা যাবে না।”
সাইকেল লেইনকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা নতুন করে আমদের নতুন ১৮টা ওয়ার্ডে ২৯ কিলোমিটার সাইকেল লেইন এবং ওয়াকওয়ে তৈরি করছি। খাল খনন করে রাস্তা প্রশস্ত করে খালের পাড়ে আমরা সাইকেল লেইন তৈরি করব। গাছ লাগাব। ইতোমধ্যে আর্মির তত্ত্বাবধায়নে কাজটা শুরু করা হয়েছে। আশা করছি চার বছরের মধ্যে এই প্রজেক্টটা শেষ হয়ে যাবে।”
তবে এ কাজে যে চ্যালেঞ্জ সামলাতে হচ্ছে, সে কথা তুলে ধরে মেয়র বলেন, “এখন খাল দখলমুক্ত করা হচ্ছে। সমস্যা হল এই খাল দখল করা বিশাল এক চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আগে এই খাল ছিল ১০০ ফুট, এখন এটা ১০ ফুট। এখন এই খাল খননের জন্যও চ্যালেঞ্জিং বিষয় হল উচ্ছেদ করা। এখানে যদি আজ একটা ওয়াকওয়ে থাকত, তাহলে আর এত কষ্ট করতে হত না আমাদের।”