আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে এজন্য কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষায় গুরুত্ব আগের তুলনায় অনেক বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) সাবেক এই মহাপরিচালক বলেছেন, অর্থনীতির শক্তি বাড়াতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মূলধন পাওয়া সহজ করতে হবে এবং বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থ বিতরণে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন খান আহমেদ সাঈদ মুরশিদ (কে এ এস মুরশিদ)।
কে এ এস মুরশিদ
আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এবার পৌনে সাত লাখ কোটি টাকার সম্ভাব্য বাজেট নিয়ে আয় ব্যায়ের হিসাব করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বিশাল আকারের নতুন এ বাজেটে কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে কে এ এস মুরশিদ বলেন, আন্তর্জাতিক সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য যে সম্ভাবনা রয়েছে তা বাজেটের মাধ্যমে প্রতিফলিত হতে হবে।
করোনাভাইরাস মহামারীর আঘাত থেকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আবার আঘাত হেনেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও ডলারের দাম গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। দেশে মূল্যস্ফীতি ১৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছেছে।
এমন অবস্থায় দেশের সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানোই বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য হতে হবে বলে মনে করেন এই গবেষক।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে পণ্যের দাম বাড়ছে। খাদ্যের উপর চাপ বাড়ছে। এগুলোর উপর আমাদের নজর দিতে হবে।
ফাইল ফটো
“আগামী বাজেটে অবশ্যই আমাদের কৃষির উপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। আমাদের বাজারে ধান উঠার পরে চালের দাম কম থাকত। এখন সেরকম হচ্ছে না। তার মানে বাজার মনে করছে, সামনে সংকট হবে।”
চলতি অর্থবছরে কৃষিখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বরাদ্দের এ হার বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
দেশে এক মাসের ব্যাবধানে কিছু চালের দাম কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। জ্বালানি ও ভোজ্য তেলসহ আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে এপ্রিলে দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ হারে।
‘স্বয়ম্ভর’ বাংলাদেশের লক্ষ্য বাজেটে চান ফরাসউদ্দিন
নতুন বাজেটে আমদানি কমানো, ব্যাংক ঋণ বাড়ানোর ছক
এ অবস্থায় কৃষিতে গুরুত্ব দিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে দেশে মূল্যস্ফীতি কমানোর পক্ষে মত দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
মহামারীর ধাক্কায় অনেক মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে নেমে গেছে এবং অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। এ অবস্থায় তাদের বাঁচাতে হলে সামাজিক কল্যাণে জোর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন কে এ এস মুরশিদ।
তিনি বলেন, “অতিদরিদ্র বা দরিদ্রদের জন্য আমাদের যে সামাজিক নিরাপত্তা আছে সেটা আরও বাড়াতে হবে।”
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১৭ দশমিক ৮২ শতাংশ রাখা।
সামাজিক সুরক্ষার ভাতা বিতরণে আগের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষতাও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
এ খাতের অর্থ সুবিধাভোগীদের কাছে যথাযথভাবে বিতরণে একটা ডেটাবেইজ করারও পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
“সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দের ক্ষেত্রে কম টাকায় বেশি রিটার্ন পেতে হলে এফিসিয়েন্সি বাড়াতে হবে। গভর্নেন্স বাড়াতে হবে। গভর্নেন্স না বাড়াতে পারলে বাজেট বাড়িয়েও কাজ হবে না।”
ফাইল ফটো
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে দরিদ্রদের একটা ডেটাবেইজ থাকতে হবে। তাহলে সেটি ধরে সাহায্য করা যাবে। আমাদের উচিত বিষয়টা দেখা।”
বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুরশিদ মনে করেন, বর্তমান পরিস্থতিতে ঝুঁকি যেমন আছে, সঙ্গে কিছুটা সম্ভাবনাও আছে। বিভিন্ন কারণে চীন থেকে বিনিয়োগ সরাচ্ছে আমেরিকাসহ পশ্চিমের দেশগুলো। সেই বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এসব কিছু মাথায় রেখেই ২০২২-২০২৩ সালের বাজেট করার পরামর্শ তার।
‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ভিকটিম’- মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই সমস্যার মধ্যে বাংলাদেশের জন্য কিন্তু সম্ভাবনাও আছে। পশ্চিমা বিশ্ব চাচ্ছে চীনের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে। কারণ চীন ঠিকমত পণ্য সরবরাহ করছে না। চীন এখন লকডাউনে চলে গেছে।
“এ সমস্যা এবং সম্ভাবনাগুলোর দিকে তাকিয়ে আমাদের বাজেট করতে হবে,” বলেন কেএএস মুরশিদ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তি বাড়াতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মূলধন প্রাপ্তি সহজ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশের ছোট ও মাঝারি যেসব ব্যবসা আছে, যেগুলো করোনাভাইরাসের পরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। তাদের জন্য যে টাকা বরাদ্ধ দিয়েছিল সরকার- সেটাতো মনে হয় তারা পায়নি। তাদের কাছে টাকা যাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।”
সরকারি বাজেটের কার্যকারিতা বাড়াতে আকার না বাড়িয়ে তা বাস্তবায়নে বেশি নজর দিতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
ফাইল ফটো
তিনি বলেন, “আমরা বিশাল বিশাল আকারের বাজেট দেই কিন্তু সেটা অর্জন করতে পারি না। অনেক টাকা ব্যবহার করা যায় না। এটাকে আর সমর্থন করা যায় না।
“আমার মনে হয় এধরনের লোক দেখানো বিশাল বাজেট না দিয়ে আমাদের একটি রিজনেবেল এবং উপযুক্ত বাজেট দিতে হবে যেটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব।”
বিআইডিএসের সাবেক এই মহাপরিচালক মনে করেন, সুশাসন বাড়ানোরও কোনো বিকল্প নেই।
“কিছু কিছু গভর্নেন্স বা সুশাসনের বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে আমরা বহুকাল ধরে কথা বলে আসছি। সেগুলোর কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমাদের কপাল ভালো যে, গত ৫০ বছরে আমাদের উন্নয়ন হয়েছে তেমন কোনও গভর্ননেন্স রিফর্ম না করেই। কিন্তু এখন যে ধরনের পরিস্থিতি তাতে আমাদের এসব সংস্কার না করলে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না।”
তিনি বলেন, “আমাদের এনবিআরের সংস্কার করতে হবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংস্কার করতে হবে- তাদেরকে তাদের কাজটা করতে দিতে হবে। আমরা বেশ কিছু বিপদজনক নীতিগত ভুল করেছি সেগুলোকে আবার ঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে।”
কে এ এস মুরশিদ বলেন, “আমাদের কিছু পলিসি রিভার্সাল হয়েছে। এক্সচেঞ্জ রেট, ইন্টারেস্ট রেট- এগুলো নিয়ে কিন্তু আমাদের কিছু পলিসি রিভার্সাল হয়েছে। আমরা বলেছি, আমরা লিবারেলাইজ করব- কিছুটা করেছি। পুরোটা করিনি। এটা করার আগেই কিন্তু আমরা পিছনে চলে এসেছি।“
এসব পদক্ষেপকে ‘বিপদজনক ভুল’ মন্তব্য করে তিনি সেগুলোকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে নতুন বাজেটে উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেন।