স্বেচ্চাসেবী সামাজিক সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এ জরিপ বলছে, যৌন হয়রানির শিকার নারীদের ৭৫ শতাংশ জানিয়েছেন,
তারা অন্য যাত্রীদের মাধ্যমেই আক্রান্ত হয়েছেন। আর ২০ দশমিক ৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদেরকে নিপীড়ন করেছে চালকের সহকারীরা।
হয়রানিকারীদের বেশির ভাগই মধ্যবয়সী পুরুষ বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, গণপরিবহনে আসনের অতিরিক্ত
লোক নেওয়ার ফলে যৌন হয়রানি বাড়ছে।
‘ঢাকা শহরে গণপরিবহনে হয়রানি:
কিশোরী এবং তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শিরোনামে
শুক্রবার অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করে সমীক্ষার ফল তুল ধরে সংগঠনটি।
হয়রানির শিকার বেশির ভাগ ভুক্তভোগী
জানিয়েছেন, ওই পরিবহনের কেউ তার পাশে
এসে দাঁড়ায়নি। তবে ৪৩ শতাংশ জানিয়েছেন অন্যদের সাহায্য
পেয়েছেন। সাহায্য পাওয়ার জন্য ৯৯৯ এর সহায়তা নিয়েছেন
মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার পেছনে
দায়ী কারণগুলো অনুসন্ধান করতে এর আগে সারা
দেশে জরিপ চালিয়েছিল আঁচল ফাউন্ডেশন।
সেই জরিপে দেশে ৪৫ দশমিক ২৭ শতাংশ নারী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে মানসিক সমস্যার
সম্মুখীন হন বলে উঠে আসে।
এরই ধারাবাহিকতায় সংগঠনের তরফে এবার শুধু ঢাকার কিশোরী ও তরুণীদের নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয় জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে
ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, “আমাদের গবেষণায় ঢাকায় বহুল
ব্যবহৃত গণপরিবহনগুলোর মধ্যে বাস, ট্রেন, লেগুনা, রাইড শেয়ারিং ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত
করা হয়েছে। আমাদের এই ডেটা সংগ্রহের জন্য অনলাইন এবং
অফলাইন উভয় পদ্ধতির সমন্বয় করা হয়েছে।”
জরিপে ঢাকা শহরের আজিমপুর, মিরপুর, গুলশান, বনানী,
ধানমন্ডি, বারিধারাসহ বিভিন্ন এলাকার ১৩
থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৮০৫ জন নারী-কিশোরী অংশ নেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৬ দশমিক ০৯ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৭ দশমিক ৭০
শতাংশ কর্মজীবী এবং ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ গৃহিণী ছিলেন।
জরিপে গণপরিবহনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে উঠে
এসেছে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা।
অংশগ্রহণকারী ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী গণপরিবহনে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হওয়ার
কথা বলেছেন। তার মধ্যে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ
বলেছেন, তাদেরকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ১৫ দশমিক
৩ শতাংশ বুলিং, ১৫ দশমিক ২ শতাংশ সামাজিক বৈষম্য, ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ লিঙ্গ বৈষম্য এবং ৮ দশমিক ২ শতাংশ বডি
শেমিংয়ের মতো হয়রানির মধ্য দিয়ে গেছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে।
কারা বেশি যৌন হয়রানি করছে, এ প্রশ্নের উত্তরে ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ কিশোরী ও
তরুণীর ভাষ্য, তারা ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের শিকার
হয়েছেন। অন্যদিকে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ জানিয়েছেন যে,
তারা কিশোর ও যুবকের (১৩-৩৯ বছর বয়সী) মাধ্যমে
যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, বাসে ওঠা-নামার সময় চালকের সহকারীরা
অযাচিত স্পর্শ করেছে।
যৌন হয়রানির ধরনের বিষয়ে ১১ দশমিক
৯ শতাংশ জানিয়েছেন তাদেরকে আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করা হয়েছে। ৩০ দশমিক
৮ শতাংশ জানিয়েছেন, যথেষ্ট জায়গা থাকার
পরেও অন্য যাত্রীরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ইচ্ছাকৃতভাবে
ধাক্কার শিকার হয়েছেন ১৪ দশমিক ২
শতাংশ। আর ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী
জানিয়েছেন, তারা বাজে মন্তব্যের শিকার
হয়েছেন।
গণপরিবহনে হালকা ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা
অবস্থায় সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন কিশোরী ও তরুণীরা। আর বসে থাকা অবস্থায় নিপীড়নের
মুখোমুখি হয়েছেন ২২ দশমিক ৯ শতাংশ।
ভুক্তভোগীদের প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে দেখা গেছে,
৩৪ শতাংশ ৮ শতাংশ ভয় পাওয়ার কারণে নীরব থেকেছেন। ২০ দশমিক ৪ শতাংশ ওই গণপরিবহন এড়িয়ে চলেছেন। আর ৪ দশমিক ২ শতাংশ ভুক্তভোগী বলেছেন, তারা সহযাত্রীদের
নিকট সাহায্যের অনুরোধ করেছেন। অন্যদিকে মাত্র দশমিক ৫
শতাংশ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
নিপীড়নের শিকার ২১ দশমিক ২ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, পরে তারা ট্রমাটাইজড হয়েছেন। গণপরিবহন ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক
৪ শতাংশের মনে। অনেকেই হীনমন্যতায় ও বিষণ্ণতায়
ভুগেছেন বলে সমীক্ষার ফলে দেখা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশনের তানসেন রোজ
বলেন, “আমরা দেখেছি গণপরিবহনে হয়রানির
শিকার হলে তরুণীদের কাজের স্পৃহা কমে যায়, তাদের বিষণ্ণতা
বেড়ে যায়। এই বিষণ্ণতা তাদেরকে আত্মহত্যার দিকেও ধাবিত করতে পারে।”
তিনি প্রতিটা গণপরিবহনকে সিসিটিভির
মাধ্যমে নজরদারির আওতায় আনা, ড্রাইভার, হেল্পারদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ দেওয়া; যে কোনো ঘটনার
সুষ্ঠু তদন্তের প্রেক্ষিতে দ্রুত বিচারের মত উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেন।
সামাজিক বৈষম্য বা অভিমতের কারণে এসব হয়রানির কথা
কাউকে জানাতে অনেকেই দ্বিধাবোধ করেন জানিয়ে
ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামিরা আক্তার সিয়াম বলেন, “এর ফলে কমে যায় তার আত্মবিশ্বাস, যা মোটেও
কাম্য নয়। তাই মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে এবং সুস্থ সমাজ গড়ার জন্যে সবাইকে
হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সেই সাথে জোরদারভাবে নারীদের সার্বিক নিরাপত্তা
নিশ্চিত করতে হবে।”
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া কিশোরী ও তরুণী
কর্মক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার প্রতিটি সড়কে নারীদের জন্য
সংরক্ষিত বাস ও আসন বাড়ানোর কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. ইসমাইল হোসাইন বলেন,
“এই সামাজিক সমস্যাকে পুরোপুরি মোকাবিলা করতে আমাদের নৈতিকতাকে ঠিক করতে হবে; সামাজিক পদক্ষেপের
মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং আইনের সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ব্যবহার
নিশ্চিত করতে হবে।
গণপরিবহন নিরাপদ করতে ১০ প্রস্তাব
>> আসন সংখ্যার
বেশি যাত্রী না তোলার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া।
>> সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে বাস
স্টাফসহ যাত্রীদের পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
>>
প্রতিটি বাসে সিটের পাশে যৌন হয়রানির
বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক লিফলেট লাগানো।
>>
বাসে সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বাড়ানো।
>> নারীদের জন্য পর্যাপ্ত
সংখ্যক আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করা।
>>
বাসের হেল্পার, সুপারভাইজার ও চালকদের পরিচয় উল্লেখপূর্বক
নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা।
>>
নিপীড়নের ঘটনায় সেই বাসের স্টাফদের
দায়ভার নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
>>
নিপীড়িত নারীর প্রতিবাদে কেউ
আক্রমণাত্মক হলে তাকে শক্তভাবে প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেওয়া।
>>
গণপরিবহনে যৌন হয়রানির ঘটনায় দ্রুত বিচার
নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা।
>>
বাসের হেলপার, সুপারভাইজার ও চালকদের জন্য যৌন
নিপীড়ন নিয়ে বিশেষ কাউন্সিলিং ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।