অর্থনীতির সূচকগুলো এখন যে জায়গায় আছে, তাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অতটা খারাপ বলে মনে করছেন না বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কেএএস মুরশিদ।
তবে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ তিনিও দেখছেন। তার ভাষায়, “বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ভিকটিম।”
বাংলাদেশ ইতিহাসের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরপরই মহামারী এসে হাজির। গত দুই বছরে অন্য সব দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সেই ধাক্কা সামলে ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশ।
কিন্তু মহামারীর মতই কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে ইউক্রেইনে যুদ্ধ লাগিয়ে দিল রাশিয়া। তাতে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হল বিশ্ব বাণিজ্যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সাজানো ঘরও নড়ে উঠছে উপুর্যপরি দুই ঝড়ে।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছেছে দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সংসারে তেল-নুনের হিসাব মেলাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।
মহামারীর ধাক্কা সামলে আমদানি বাড়ায় স্বস্তিই পাচ্ছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু সার্বিক বিশ্ব পরিস্থিতিতে ডলারের দাম চড়তে থাকায় পণ্য আমদানিই এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য ইতিহাসের সর্বোচ্চে ঘাটতিতে পড়েছে। ডলারের দর হয়ে উঠেছে পাগলা ঘোড়া। ২০২১ সালের মে থেকে ২০২২ সালের মে- এই এক বছরে ডলারের বিপরীতে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ মান হারিয়েছে টাকা।
এদিকে রপ্তানি বাড়লেও রেমিটেন্সে টান পড়েছে। কিন্তু পণ্য আমদানি করতে গিয়ে ডলার বেরিয়ে যাচ্ছে অনেক। তাতে চাপ পড়ছে রিজার্ভে।
ভয়ের ক্ষেত্র আরও পোক্ত করেছে শ্রীলঙ্কা। ডলারের সঙ্কটে সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশটি নাম লিখিয়েছে ঋণখেলাপির খাতায়। মূল্যস্ফীতি আর অর্থনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি পাকিস্তানেও সরকারপতন ঘটিয়েছে। পণ্যমূল্যের দাবানল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলোকেও পোড়াচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংক এ বছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস প্রায় পুরো এক শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এ সংস্থার প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস মে মাসের শেষে যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “কীভাবে মন্দা এড়ানো যায়- সেই পথ খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।”
আর ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান অর্থনীতিবিদ সায়মন ব্যাপটিস্ট বলছেন, এ দফায় বিশ্ব মন্দা যদি এড়ানো সম্ভবও হয়, অন্তত বছরখানেকের জন্য পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় এই অস্থিরতা, মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার আর প্রবৃদ্ধির ধীর গতির সঙ্গেই চলতে হবে বিশ্বকে।
এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশও কি মন্দার দিকে যাবে? নাকি অর্থনীতিতে যে গতি ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ছিল, সেই পথে আবার ফিরতে পারবে?
গবেষণা সংস্থা সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলছেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীলতা ছিল, বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অস্থিরতা তাকে বড় ধরনের চাপে ফেলে দিয়েছে।
“রাশিয়া- ইউক্রেইন যুদ্ধই এই চাপ তৈরির প্রধান কারণ। এর ফলে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে।”
সেলিম রায়হানের মতে, মহামারীর সময়ও এতটা চাপ ছিল না, যেটা বাংলাদেশ এখন মোকাবেলা করছে।
ফাইল ছবি
জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে ‘অভয়’
কোনো বছর মোট উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় কতটা বাড়ল, সেই তুলনামূলক হারকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় জিডিপি প্রবৃদ্ধি। কোনো বছর মোট উৎপাদন না বেড়ে কমে গেলে বলা হয় অর্থনীতি ‘সঙ্কুচিত’ হয়েছে। তখন জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নেমে আসে শূন্যের নিচে। অর্থনীতির ওই দশাকেই ‘মন্দা’ বলে।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। এরপর এল মহামারী। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা কমে হল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
মহামারীর ধাক্কা সামলে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে। মহামারীর দুঃসময় কাটিয়ে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি এবার ৭ শতাংশের ঘর অতিক্রম করতে যাচ্ছে বলে গত মাসে ধারণা দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস।
অর্থাৎ, অর্থনীতির ভাষায় বাংলাদেশের মন্দায় পড়ার ঝুঁকি অন্তত পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলনে দেখা যাচ্ছে না।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের হিসাব ধরে প্রবৃদ্ধির এই প্রাক্কলন করেছে বিবিএস। তাতে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সাময়িক হিসাবে স্থির মূল্যে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হতে পারে।
তাতে কিছুটা সংশয় আছে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেনে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা অর্জন করা ‘সম্ভব নাও হতে পারে’।
“মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল, সেটা মাত্র ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করেছিল। এর মধ্যেই ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এটা আমাদের প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তায় বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাবে।”
গত মাসে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারী থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোভাবেই পুনরুদ্ধারের পথে ছিল। কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে এবং বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গতিও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
বাজার দরের চেয়ে কম দামে নিত্যপণ্য কেনার জন্য টিসিবির ট্রাকের সামনে ভিড়। ফাইল ছবি
চোখ রাঙাচ্ছে মূল্যস্ফীতি
যুদ্ধের জেরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই পণ্যমূল্য বাড়ছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। ক্রমশ বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলছে অর্থনীতির স্বাস্থ্য।
বাংলাদেশেও অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ সূচক মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ হারে, যা ১৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
দেশের বাজারে সবচেয়ে জরুরি খাদ্যপণ্য চালের দাম এক মাসের ব্যাবধানে কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। অস্থিরতা আছে অন্যান্য পণ্যের দামেও।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩০ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। পরে তা সংশোধন করে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়। তবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাবে, বছর শেষে এই হার ৬ শতাংশের উপরেই থাকবে।
সেলিম রায়হান বলেন, “মূল্যস্ফীতির ওপর বেশ বড় ধরনের চাপ আছে। এর মধ্যে একটা রয়েছে আমদানি নির্ভর মূল্যস্ফীতি। বাজারে ডলারের সরবরাহ কমিয়ে বাড়িয়ে টাকার মানের বিষয়ে গত এক দশকে যে একটা স্বস্তির জায়গা ছিল, সেখানেও একটা বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে।”
আগামী দিনগুলোতে এই চাপ সামলাতে কৃষির ওপর জোর দিতে বলছেন কে এ এস মুরশিদ। সেজন্য কৃষিতে জোর দেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক কল্যাণে আরও বেশি নজর দেওয়ার পরামর্শ রেখেছেন তিনি সরকারের সামনে।
রেমিটেন্সে ভাটা
ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি আগের বছরের অর্ধেকে নেমে আসতে পারে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। বাংলাদেশও প্রবাসী আয়ে ধীর গতি টের পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে প্রবাসীরা মোট ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। মে মাসের এই অংক আগের মাস এপ্রিলের চেয়েও ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ কম।
অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে মোট রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার ৯১৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে তুলনায় তা ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম।
বাংলাদেশে জিডিপির ১২ শতাংশের মত আসে প্রবাসে থাকা কর্মীদের পাঠানো অর্থ থেকে। দেশের বিদেশি মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় প্রধান উৎস এই রেমিটেন্স। প্রবাসী আয় কমে গেলে রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়তেই থাকবে।
এই ধাক্কা সামলে প্রবাসী আয়ে গতি ফেরাতে নগদ প্রণোদনা বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থের উৎস প্রকাশের বাধ্যবধকতা তুলে নিয়েছে সরকার।
তবে প্রবাসীরা যেসব দেশে আছেন, সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেলে দেশে পরিবারের কাছে বেশি টাকা পাঠানোর সুযোগ তাদের থাকবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও সেটা ভালো খবর দেবে না।
ফাইল ছবি
লেনদেন ভারসাম্যে রেকর্ড ঘাটতি
মহামারীর প্রথম বছরেও অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট) বড় উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দুই বছরের মাথায় তা ইতিহাসের সের্বোচ্চ ঘাটতিতে পৌঁছেছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩২ কোটি ডলার।
গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ১৬৫ কোটি ডলার। আর ২০২০-২০২১ অর্থবছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৫৮ কোটি ডলার। তার আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৫৪৪ কোটি ডলার।
দেশের ইতিহাসে লেনদেন ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে এত বড় ঘাটতি আর কখনও হয়নি। এর আগে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের ৯৫৬ কোটি ডলারের ঘাটতিই ছিল সবচেয়ে বড়।
কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়।
এখন এই ঘাটতি বাড়ার মূল কারণ আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়া। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও দ্রুত কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে ৬ হাজার ৮৬৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪ হাজার ১১০ কোটি ডলার।
এই সময়ে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় ৪১ দশমিক ৪২ শতাংশ বেড়েছে, রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
তাতে সার্বিক বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ৭৫৬ কোটি ডলার, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
গত অর্থবছরের এই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৮০১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এবারের ১০ মাসের ঘাটতি তার চেয়ে প্রায় ৫৩ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরের পুরো সময়ে ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ, এ অর্থবছরের দশ মাসেই আগের অর্থবছরের পুরা সময়ের চেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
রিজার্ডেও টান
ডলারের মূল্য বাড়ায় রিজার্ভ সহনীয় পযায়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা। গত দুইমাসে পাঁচবার টাকার বিপরীতে ডলারের মান বাড়ানোর পর সমালোচনার মুখোমুখি পড়তে হয়। বৃহস্পতিবার ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
একইসঙ্গে দেশের ডলারের মজুদ বাজারে বেশকিছু আমদানি পণ্যের চাহিদা কমাতে নিয়ন্ত্রণমূলক করারোপ করা হয়েছে। রেমিট্যান্স সহায়তা বাড়াতে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।
গত ২৫ মে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪২ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে বর্তমান আমদানির ধারা অনুযায়ী ৬ মাসের ব্যয় মেটানো সম্ভব। অথচ গতবছর অগাস্টে রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল।
সেলিম রায়হান বলেন, “এখন দেখা যাচ্ছে এক্সেপোর্টের সাফল্য থাকলেও রেমিটেন্সে রয়েছে নেগেটিভ গ্রোথ। সেই সঙ্গে রয়েছে আমদানির বড় ধরনের একটা উল্লম্ফন। সামগ্রিকভাবে দেশের বাজারে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়েছে। এই চাপটা সামলানোর জন্য বাংলাদেশে ব্যাংক যেভাবে ডলারের সাপ্লাই দিয়ে গেছে সেটার একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে; ফরেন রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।”
ফাইল ছবি
অন্য সূচকগুলো কেমন আছে?
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, রিজার্ভ কমে আসা, মূল্যস্ফীতি, আমদানি ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া ছাড়া অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর অবস্থা ইতিবাচক বলে মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা।
চলতি অর্থবছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৬৯ শতাংশ। আগের বছর একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি।
সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে পৌঁছাবে, যা গত অর্থবছরে ২ হাজার ৫৯১ ডলার ছিল।
মাথাপিছু আয় এক হাজার ডলার পার হতে সময় লেগেছিল ৪০ বছর। এরপরের ১০ বছরের দ্রুতগতিতে অর্থাৎ ১৮০ শতাংশ বেড়েছে।
অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট জিডিপি বেড়ে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার হবে বলে প্রাক্কলন করেছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। জিডিপির আকারে বাংলাদেশের বাংলাদেশ বৃহৎ ৪০টি অর্থনীতির দেশের মধ্যে চলে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পযন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২.৪৮ শতাংশ। সরকারের বিদেশি ঋণ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯০.৭৯ বিলিয়ন ডলার। দেশি ঋণ মার্চ পর্যন্ত ৬ লাখ ১৭ হাজার কোটি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলওর) হিসাবে, ২০২০২ সালে ৩৬ লাখ মানুষ বেকার থাকবে, যা আগেনর বছরের থেকে ৫ লাখ বেশি।
ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ২১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। আগের বছরে এই সময় বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ছিল ১৯ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
টিসিবির ট্রাক থেকে কম দামে পণ্য কিনে ফিরছেন এই নারী। ফাইল ছবি
পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগের?
সার্বিকভাবে অর্থনীতির ওপর কিছুটা চাপ থাকলেও এখনও চিন্তিত হওয়ার মত কিছু দেখছেন না বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “করোনার দুই বছরের একটা প্রভাব গেছে। এখন যুদ্ধ চলছে। জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে না, দাম বেশি। কিছু সমস্যাতো আছেই। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির যে স্ট্রেংথ আছে তাতে অত আপসেট হওয়ার মত কিছু দেখি না।”
মহামারীর ধাক্কার পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে জায়েদ বখত বলেন, “আমাদের অর্থনীতি যে গতিতে রিকভারি হচ্ছে, ক্রেডিট গ্রোথ অব প্রাইভেট সেক্টর ১২ শতাংশের মত হয়ে গেছে। এত আমদানি হচ্ছে। কেন হচ্ছে এসব?
“ব্যবসায়ীদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তাদেরও হিসাব-নিকাশ আছে। তারাতো দেখতে পাচ্ছে যে, সামনের দিকে ভালো সময় আসবে। ভালো করতে পারবে। সেজন্য তারা বিনিয়োগ করছে, সম্প্রসারণ করছে। ব্যাংক থেকে ঋণ দিচ্ছে। ব্যাংকে বরং এখন কিছুটা তারল্য স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে।”
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সঠিকভাবে হলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ‘ভালোর দিকেই যাবে’ বলে এই অর্থনীতিবিদের বিশ্বাস।
বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনও উদ্বিগ্ন নন। তবে তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং এর অভিঘাত থেকে প্রান্তিক মানুষকে রক্ষার জন্য খাদ্য ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন।
সেইসঙ্গে আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যে সরকারি নীতি সহায়তা দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “সরকার বিচক্ষণতার সঙ্গে এসব কৌশল বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।”
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ফয়সাল আতিক, ফারহান ফেরদৌস ও শেখ আবু তালেব। ]