নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কদমরসুল এলাকার ওই ডিপোতে শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে লাগা আগুন রোববার বেলা ১টা পর্যন্ত পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি।
সীতাকুণ্ডে উদ্ধার তৎপরতা শুরুর পর রাত ১২টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের হাসপাতালে আনা শুরু হয়। এক পর্যায়ে রোগীর চাপ বেড়ে গেলে এন্ট্রি করার চেষ্টা বাদ দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার জানান, রোববার দুপুর পর্যন্ত মোট ৩৭ জনের মরদেহ মর্গে এসেছে। দগ্ধ ও আহত শতাধিক ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
মেডিকেল কলেজের বারন্দায় দাঁড়িয়ে কলেজছাত্রী সূচনা (২০) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, নিখোঁজ বড় ভাই শাহজাহনের খোঁজে বাবা তাজুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এসেছেন।
তাদের বাড়ি ফটিকছড়িতে, চট্টগ্রামে তারা থাকেন শহরের মনসুরাবাদ এলাকায়। ট্রাক চালক শাহজাহান পণ্য নিয়ে ডিপোতে গিয়েছিলেন শনিবার রাতে। আগুন লাগার আগে মোবাইল ফোনে তার স্ত্রীর সঙ্গে শেষবার কথা হয় বলে জানান সূচনা।
বড় ভাই ট্রাক চালক শাহজাহনের খোঁজে হাসপাতালে এসেছেন বোন সূচনা
তিনি বলেন, “আমরা রাতে এই ঘটনা জানতাম না, সকালে জানতে পেরেছি। সকাল থেকেই ভাইয়ের ফোন বন্ধ পাই। ডিপোতে ট্রাক আছে, ভাই নেই।”
রোববার ভোর থেকে সূচনাদের মত অনেকেই নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে হাসপাতালে ভিড় করতে শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ড আর বারান্দায় সেই ভিড়ও বাড়তে থাকে। অনেকে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও খোঁজাখুঁজি করেন।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেইটে কোনো অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ালেই সেটির কাছে ছুটে যাচ্ছেন স্বজনরা। আবার সংবাদকর্মী বা পুলিশ সদস্যদের সামনে গিয়ে হাতের মোবাইল থাকা ছবি দেখিয়ে জানতে চাইছেন স্বজনের খোঁজ।
পঞ্চাশোর্ধ আলী নেওয়াজ জানালেন রাত থেকে ছোট ভাই আবদুর রহমানকে ফোনে না পেয়ে বাঁশখালী থেকে ভোরে নগরীতে ছুটে এসেছেন তিনি।
সীতাকুণ্ডে ডিপোতে আগুন-বিস্ফোরণে দগ্ধ ও আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আলী নেওয়াজ বলেন, রহমান কন্টেইনার ডিপোতে আট বছর ধরে কাজ করেন। শনিবার রাতে ডিপোতে আগুন লাগার পর ভিডিও কলে স্ত্রীর সাথে কথা বলে আগুনের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তার মোবাইল বন্ধ।
আলী নেওয়াজ বলেন, “হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে খোঁজ নিয়েছি, পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও খোঁজ নিয়েছি কিন্তু কোথাও পাইনি।”
শনিবার মালামাল নিয়ে ডিপোতে গিয়ে বিস্ফোরণের পর নিখোঁজ হন কভার্ড ভ্যান চালক মো. সুমন। তার বাড়ি নোয়াখালীর সোনাপুর। ছোট ভাই আর বোনকে নিয়ে শহরের নিমতলা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন সুমন।
বিস্ফোরণের পর ভাইয়ের সন্ধান না পেয়ে হাসপাতালে আসা তার ছোট ভাই মানুন বলেন, “রাতে ডিপোতে আগুন লাগার পর আমাকে ফোন করে জানাল। কিন্তু পরে ফোন করে আর পাইনি। মোবাইল বন্ধ পাচ্ছি। সকালে হাসপাতালে আসলাম, বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে কোথাও পেলাম না।”
চট্টগ্রাম শহরের কলসিদীঘি পাড় এলাকার মো. ফারুক ওই ডিপোতে ট্রাকে মালামাল তোলা-নামানোর কাজ করেন। আগুন ও বিস্ফোরণের পর তিনিও নিখোঁজ বলে জানালেন তার মেয়ে ফাতেমা বেগম (২৪)।
ইপিজেড এলাকার একটি পোশাক কারখানার কাজ করা ফাতেমা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, দুর্ঘটনার পর রাতেই ডিপো এলাকায় গিয়ে বাবাকে তিনি খুঁজেছেন। সেখানে না পেয়ে সকাল থেকে হাসপাতালে বসে আছেন বাবার খবর পেতে।
এদিকে তোহা নামে একজনের খোঁজে হাসপাতালে ঘুরছেন তার ফুপাতো ভাই মিজান।
তিনি জানান, বাঁশখালীর নাপোড়ার তোহা কন্টেইনার ডিপোর ক্রেইন অপারেটর। আগুন লাগার পর থেকে তোহার কোনো খোঁজ তারা পাচ্ছেন না।
মিজান বলেন, শনিবার রাতে আগুন লাগার খবর পেয়ে প্রথমে ডিপো এলাকায় গিয়ে তোহাকে খুঁজেছেন তারা। কিন্তু সেখানে না পেয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরেছেন, ভাইকে পাননি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিছুর রহমান জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও বারবার বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ডিপোতে রাসায়নিক থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়।
রাসায়নিকের কারণে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ায় দীর্ঘ সময় ধরে চোখ জ্বালা করার কথাও বলছেন হাসপাতালে ভর্তি অনেকে।