শনিবার রাত থেকে রোববার বিকাল পর্যন্ত ওই ডিপোতে ভয়াবহ আগুনের পেছনে ওই হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডই কারণ বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। মর্মান্তিক ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ডিপোতে এই রাসায়নিক থাকার খবর তাদের জানানোই হয়নি। সেখানে আর কোন কোন ধরনের রাসায়নিক আছে- সে বিষয়েও তেমন তথ্য নেই তাদের কাছে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা প্রথাগতভাবে পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেছেন, কারণ ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল, সেটা ডিপোর কেউ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের জানায়নি।
“রাসায়নিক থাকার কথা জানতে পারলে আমরা হয়ত অন্যভাবে এগোতাম; আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারতাম, ফোম ব্যবহার করতে পারতাম।”
বিএম কন্টেইনার ডিপোতে যে নীল রঙের জার রয়েছে সেগুলো প্লাস্টিকের। কিছু জার গলে গেছে, আবার কোনোটি ফেটে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।
জারের ওপর স্টিকারে বড় করে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ৬০%’। ৩০ কেজির ওই জারের স্টিকারেই লেখা রয়েছে ‘দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এবং তাপ পেলে বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে’।
একটি জারে উৎপাদনের তারিখ রয়েছে ২৮ এপ্রিল ২০২২। মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ২৭ এপ্রিল ২০২৩। জারের স্টিাকারে লেখা উৎপাদক কোম্পানির নাম আল রাজী কেমিকেল কমপ্লেক্স।
ওই কন্টেইনার ডিপোর এক কর্মতকর্তা বলেন, রাসায়নিকগুলো রপ্তানির জন্য সেখানে রাখা হয়েছিল। বিএম কন্টেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান আল রাজী কেমিকেল কমপ্লেক্সেরও একজন উদ্যোক্তা। তারা মূলত কাঁচামাল আমদানি করে প্রক্রিয়াজাত করার পর জারে ভরে আবার রপ্তানি করেন।
আল রাজী রাসায়নিক কমপ্লেক্সের মহাব্যবস্থাপকের (প্রশাসন) দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক ডিআইজি প্রিজন্স মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।
রাসায়নিকগুলো প্রটোকল অনুযায়ী সংরক্ষণ করা হয়েছিল কি না বা সেগুলোর আইনগত অনুমোদন রয়েছে কি না- জানতে চাইলে শামসুল হায়দার বলেন, “আমিও এগুলো এখনও ঠিকমত জানি না। এই প্রশ্নগুলো আমারও।
“এগুলো ঠিকমতো রাখা হয়েছিল কি না, এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ কী না- এসব তথ্য জানাতে বলেছি স্টাফদের। এরপর আমরা সংবাদ মাধ্যমকে জানাব।”
তার ভাষ্য, “এখন আমরা তো এতোগুলো মানুষের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারব না। তবে আহতদের চিকিৎসাসহ সবরকম সহায়তা করতে আমাদের কোম্পানি প্রস্তুত।”
হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরণের কারণ কিনা সে বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরিত হবে কি না সেটা এর পারিপার্শ্বিক অনেকগুলো অবস্থার ওপর নির্ভর করবে।
“এটার আশপাশে কী ছিল, কীভাবে রাখা হয়েছিল, কতোদিন রাখা হয়েছিল- ইত্যাদি কন্ডিশনের ওপর নির্ভর করছে বিষয়টা। অনেক সময় দেখা যায় অনেকদিন রেখে দিলে এটা বিস্ফোরক আচরণ করতে পারে।”
উচ্চ তাপে ও অন্য আরও কিছু পরিস্থিতিতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরিত হতে পারে বলে জানান বেসরকারি রাসায়নিক পরীক্ষাগার ইন্টারটেকের রসায়নবিদ (উপ-ব্যবস্থাপক) সুনন্দা রানী বর্মন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “রাসায়নিক সংরক্ষণের বৈশ্বিক নিয়ম ‘ম্যাটেরিয়াল সেইফটি ডেটাশিট’ অনুযায়ী, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাখতে হবে গ্লাস, স্টেইনলেস স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম অথবা প্লাসিক কনটেইনারে। অন্য কোনো ধাতুর সংস্পর্শ পেলে এটা বিক্রিয়া করে।
“এটা প্রপার ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা সম্বলিত জায়গায় রাখতে হবে, নাহলে সমস্যা হতে পারে। এটা খুবই রিয়্যাক্টিভ এবং অক্সিডাইজিং এজেন্ট। উচ্চ তাপে ও অন্য আরও কিছু পরিস্থিতিতে বিস্ফোরণ হতে পারে। কখনও পানির সংস্পর্শে এলেও বিস্ফোরক আচরণ করতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে আগুন নেভাতে ফোম ব্যবহার করতে হয়।”
ওই ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাখার বিষয়ে অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক (যুগ্ম সচিব) মোহা. নায়েব আলী বলেন, এই রাসায়নিক উপাদানটি তাদের কার্যতালিকাভুক্ত বিস্ফোরক নয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সীতাকুণ্ডে কোন রাসায়নিক থেকে বিস্ফোরণটা হয়েছে তা এখনও আমরা নিশ্চিত নই। সেখানে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বা অন্য কী রাসায়নিক ছিল কি না, তার তথ্য এখনও আমাদের হাতে নেই।”
শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডের ওই ডিপোতে লাগা আগুন এখনও পুরোপুরি নেভানো যায়নি। আগুন লাগার পর রাসায়নিকের কন্টেইনারে একের পর এক বিকট বিস্ফোরণ ঘটতে থাকলে বহু দূর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।
অগ্নিকাণ্ড ও ভয়াবহ বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪১ জন হয়েছে; দগ্ধ ও আহত দুই শতাধিক ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আরও খবর
সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন, বিস্ফোরণ: মৃত্যু বেড়ে ৪১