ক্যাটাগরি

‘বারবার বিস্ফোরণ, বিষাক্ত ধোঁয়া’: বেঁচে ফেরাদের বর্ণনায় কন্টেইনার ডিপোর নরককুণ্ড

পেশায় কভার্ড ভ্যানের চালকের সহকারী বাবু বললেন, তার মনে হয়েছে ধোঁয়ার মধ্যে বিষাক্ত কিছু ছিল, যার কারণে তার চোখে জ্বালাপোড়া থামছে না। 

বিএম কন্টেইনার ডিপো নামের ওই বেসরকারি ডিপোতে প্রায় ৪৩০০ কন্টেইনার ছিল। তার মধ্যে কিছু কন্টেইনারে বিভিন্ন রাসায়নিক ছিল। আর রাসায়নিক থাকায় সেখানে বারবার বিস্ফোরণ ঘটছে, ছড়াচ্ছে বিষাক্ত ধোঁয়া।

চট্টগ্রাম নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কদমরসুল এলাকায় ২৪ একর জমির ওপর ওই কন্টেইনার টার্মিনালে শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন লাগে।

ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট সারারাত চেষ্টার পর সকালে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু বারবার বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে বলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিছুর রহমান জানান।

সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের নেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: সুমন বাবু

রোবাবর বেলা ১১টার পরও বিভিন্ন কনটেইনার জ্বলতে দেখা যায়। ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠছিল ধোঁয়া।

ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৩২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস কর্মীও আছেন। আহত হয়েছে দুই শতাধিক। 

ওই ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ থাকার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে জানান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাঈনুদ্দিন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সেখানে কয়েকটি ড্রামে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড লেখা দেখেছেন তারা। সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দলও উপস্থিত হয়েছেন রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণের জন্য।

রাতে যখন আগুন লাগল, বিএম ডিপোতে মালামাল নামানোর অপেক্ষায় ছিলেন কভার্ড ভ্যানের চালকের সহকারী আনোয়ার হোসেন বাবু।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, রাতে আগুন লাগার পর তিনি আর তার গাড়ির চালক সোহেল রানাকে খুঁজে পাচ্ছেন না।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে শনিবার রাতে লাগা আগুনে শত শত কন্টেইনার পুড়েছে। রাসায়নিক থাকায় দফায় দফায় বিস্ফোরণে আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। ছবি: সুমন বাবু

শনিবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা থেকে রপ্তানি পণ্য নিয়ে তাদের কভার্ড ভ্যানটি ডিপোতে প্রবেশ করে। সামনে গাড়ির দীর্ঘ সারির কারণে তিনি গাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন। রাত ৯টার দিকে চালক সোহেল তাকে ডেকে দেন।

এরপর সোহেল গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর গিয়ে ফোনে যখন তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, ঠিক সে সময়ই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

এরপর চালককে খুঁজে না পেয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে বের হয়ে আসেন আনোয়ার। তবে আগুনের হলকায় তার পা পুড়ে যায়।

দুই পায়ের হাঁটুর নিচে দগ্ধ হওয়ায় আনোয়ারকে রাতেই হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার মালিক। পা ব্যান্ডেজ করা আনোয়ার ভোর সোয়া ৪টারর দিকে হাসপাতালের বিছানায় বসে যখন কথা বলছিলেন, তার চোখের জ্বালা কমাতে ড্রপ দিচ্ছিলেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী।

আনোয়ার বলেন, ডিপোতে থাকতেই তার চোখ জ্বলা শুরু হয়, তখন দম বন্ধ হয়ে আসছিল।পরে ডিপো থেকে বের হয়ে বায়েজিদ লিঙ্ক রোডে গিয়ে চোখের জ্বালা কমাতে তিনি গোসল করেন, কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।

ডিপোতে যখন আগুন লাগে, তখন অনেক কভার্ড ভ্যানের চালকই গাড়িতে ছিলেন না। ডিপোতে গাড়ির জটে পড়ে গিয়ে অনেক চালকই সহকারীকে গাড়িতে বসিয়ে রাতের খাবার খেতে বা অন্য কাজে ভ্যান থেকে বের হন। 

আগুন লাগার পর কন্টেইনার ডিপো থেকে চালক না থাকা কভার্ড ভ্যান বের করার দায়িত্ব পড়ে বিসমিল্লাহ ট্রান্সপোর্টের চালকের সহকারী রনি ও শাহজালালের।

ওই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে রনি জানান, রাত ৯টার দিকে আগুন লাগার পর পানি দেওয়া হলে আগুনের হল্কা বের হতে থাকে। তবে আগুন ছড়িয়ে পড়েনি… রাত ১১টার পর বিকট শব্দ হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।”

আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় কন্টেইনারে থাকা গাড়িগুলোর সামনের কাচ ভেঙে যায়। দূরেও বিভিন্ন দোকান ও বাড়ি ঘরের কাচ ভেঙেছে। আর বিষ্ফোরণের পর চোখমুখে জ্বালা শুরু হওয়ার কথা রনিও জানিয়েছেন।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা তার সহকর্মী শাহজালাল বলেন, তারা শতাধিক গাড়ি ডিপো থেকে বের করে দূরে সড়কের পাশে রাখেন।

“সবশেষ যে গাড়িটা বের করলাম, বিস্ফোরণে সেটারও গ্লাস গেছে। ওই সময় আমার মুখে গ্যাস ঢুকছে। গ্লাস গলে পা পুড়ে গেছে।”