ক্যাটাগরি

বৈষম্য কমাতে বাজেটে রাজনৈতিক রূপরেখা চায় সিপিবি

আগামী
বাজেট কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে রাজধানীর পল্টনের মুক্তি
ভবনের দলীয় কার্যালয়ে শনিবার ‘আসন্ন বাজেট; বৈষম্য ও দুঃশাসনের পুঁজিবাদ’ শীর্ষক আলোচনাসভার আয়োজন করে সিপিবি।

সভায়
যোগ দিয়ে উচ্চ আমদানি, মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি, নেতিবাচক রেমিটেন্স, বৈদেশিক মুদ্রার
বিনিময় হার ও খেলাপি ঋণের চাপে থাকা অর্থনীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদরা।

সিপিবি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান
অধ্যাপক এম এম আকাশ আলোচনাসভায় মূলপ্রবন্ধ
উপস্থাপন করেন।

তিনি
বলেন, “রাষ্ট্র ক্ষমতায় যদি সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল
ধনী বিভিন্ন গোষ্ঠীর আধিপত্য বজায় থাকে তাহলে আধিপত্য যতো বাড়বে বৈষম্য ততো বৃদ্ধি
পাবে।”

ধনী,
গরিব ও মধ্যবিত্তের মধ্যে আয় বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে দাবি করে সভায় বলা হয়, বাংলাদেশে
ইতোমধ্যে ঋণ খেলাপী, কালো টাকার মালিক, টাকা পাচারকারী গোষ্টীতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে।

আকাশ
বলেন, “অসৎ আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের ত্রিভুজ চক্র
রাষ্ট্র ক্ষমতাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছে। এ নেতিবাচক
পরিস্থিতির পরিবর্তন জনগণের সামনে প্রধান এজেন্ডা।

তিনি
বলেন, “এখন চলছে ধনীকে আরও ধনী আর গরীবকে
আরো গরীব করা। ক্ষমতাসীন ধনীদের ‍উন্নতি হয়েছে রকেটের গতিতে আর ক্ষমতার বলয়ের বাইরে
থাকা লোকদের উন্নতি হয়েছে শামুকের গতিতে।”

বৈশ্বিক
পরিস্থিতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “একদিকে ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ বাড়ছে, আবার তেলের দাম বৃদ্ধিতে
পরিবহন খরচও আগের চেয়ে বাড়ছে। যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে।”

এমন
পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে অর্থমন্ত্রীকে ‘উভবিরোধের’ ভেতর দিয়ে হাঁটতে হবে উল্লেখ করে এম এম আকাশ বলেন,
“আগামীতে মূল্যস্ফীতি সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।”

বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী, নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সঙ্গে
না বসে শুধু ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের একটি অংশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আনু মুহাম্মদ।

তিনি বলেন, “এতে সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করছে না। কেন প্রকল্পের সময় ও খরচ বাড়ছে তার
কোনো স্বচ্ছ হিসাব পাচ্ছে না কেউ। প্রকল্প জনগণের কতোটুকু সুবিধা দেবে, জনগণ এসব প্রকল্প
চাইছে কি না, তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। শুধু বড় বড় প্রকল্পের কথা প্রচার হচ্ছে।”

“বিশ্বের মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই সর্বোচ্চ খরচ করে সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করা
হচ্ছে। এর দায় কিন্তু জনগণের ঘাড়েই বর্তাচ্ছে।”

শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, দেশটি বেশি মাত্রায় বৈদেশিক
ঋণ ও বড় বড় প্রকল্পে জড়িয়েছিল। দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ায় এক সময় বাংলাদেশের চেয়ে মাথাপিছু
আয় বেশি থাকা দেশটি এখন ঋণগ্রস্ত।

সভায় বলা হয়, অন্যান্য দেশ যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে
শক্তিশালী করে বিদেশেও কাজে লাগাচ্ছে; সেখানে দেশীয় চিনি, পাট ও বস্ত্রকলগুলোকে বন্ধ
করে দেওয়া হচ্ছে।

উদাহরণ হিসেব বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের
পদ্মাসেতুর কাজ করার এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠানের রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
করার কথা উল্লেখ করা হয়।

এসময় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেওয়া
হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়।

বৈষম্য বেশি থাকলে মাথা পিছু আয় নিয়ে ভ্রান্ত্রি সৃষ্টি হয় জানিয়ে
মাথাপিছু গড় আয় নিয়ে সরকারের দেওয়া তথ্যের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন আলোচকরা।

আনু মোহাম্মদ বলেন, “মাথাপিছু গড় আয় যা দেখানো হচ্ছে তাতে জনগণের প্রকৃত আয় বাড়ে না। সরকার যে
হিসাব দিচ্ছে সে অনুযায়ী মানুষের আয় কিন্তু বাড়ছে না।

“আমরা শিক্ষা, চিকিৎসায় পরিবর্তন দেখতে চাই। চিকিৎসা অধিকার, এটি ব্যবসা না,
যা করোনা প্রমাণ করে দিয়ে গেছে। এরপরও সচেতন হব না?”

শিক্ষা, চিকিৎসা ও সুরক্ষার বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর
রহমান বলেন, “শিশুদের
নিয়ে ভাববার সময় হয়েছে।

“তারা শুধু শ্রেণি পরিবর্তন করছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করোনার সময়ে। কিন্তু তাদের
শিক্ষার উন্নয়নের জন্য আগামী বাজেটে কী আছে? পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কী রেখে যাব?

“উচ্চবিত্তের শিক্ষা নিয়ে সমস্যা নেই। তাদের সন্তানরা অন্য দেশে যাচ্ছে। কিন্তু
সিংহভাগ শিক্ষার্থী দেশেই পড়ছে।”

সরকারি পরিসংখ্যানে গলদ রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে বৈষম্য
বাড়ছে। সম্পদ ও আয় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায়
অগ্রাধিকার দিতে হবে।

“বৈষম্য কমিয়ে আনতে সুশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সাশ্রয়ী হওয়ার উপর গুরুত্ব
বাড়াতে হবে। বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য আগামী বাজেটে রাজনৈতিক দর্শনটি দেখতে চাই আমরা।”

মূল্যস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক বৈষম্য কমাতে গ্রামীণ জীবিকার সংস্কার ও শ্রমজীবী মানুষের আয় বাড়ানোর
ওপর জোড় দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের
অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শরমিন্দ নীলোর্মি।

তিনি বলেন, “স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল সাম্য প্রতিষ্ঠা। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে অধিকার
ফিরে পেতে মানুষ যুদ্ধ করেছে। যাতে স্বাধীনতার সুফল সমহারে সবাই পায়।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ভূমিকায়
রাজনৈতিক দর্শনে সাম্যর কথাই লিখেছেন বলে উল্লেখ করেন অর্থনীতির এই সহযোগী অধ্যাপক।

“সেই সাম্য প্রতিষ্ঠা আজো হয়নি। শ্রমজীবী মানুষ এখন ধানের দাম পায় না। ন্যায্য
মজুরি পাচ্ছে না।”

বৈষম্য নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য-উপাত্ত
নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলেও জানান তিনি।

শাহিন রহমানের সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন সিপিবি’র সভাপতি কমরেড মোহাম্মদ শাহ
আলম।