মিরপুরে একটি রাস্তার মোড়ে শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে চা-নাস্তা সারছিলেন রিকশা চালক আজমল। কিন্তু টাকা দিতে গিয়ে এমন দাম শুনে তার চোখ কপালে উঠে যায়।
মালিবাগের একটি রাস্তার মোড়ে এদিন সকালে নাস্তা করে একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হন রিকশাচালক মোমিন।
তিনি বলেন, “সারাদিন রিকশা চালাইয়া ইনকাম করি যা, তাতে সংসার চালাইতেই কষ্ট হয়। তার ওপর রিকশা চালাইতে যাইয়া সারাদিনে এক/দুই/তিন কাপ চা খাওয়া পড়ে। এর লগে বনরুটি বা পাউরুটির এক/দুই পিস লাগে।
“এহন হেই রুটির দামও গেছে বাইড়া। আমরা যামু কৈ? প্যাডে কিছু না দিলে রিকশাই বা চালামু কেমনে? ”
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির এই সময়ে মাসের শুরু থেকে হঠাৎ করেই রুটি-বিস্কুট, কেকসহ নিত্যদিনের বেকারি পণ্যের দাম ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, যা বেকারির ‘ইতিহাসে সর্বোচ্চ’।
ঢাকার পাড়া মহল্লা, কিংবা অলিগলির দোকানে চাল-তেল-ডালের মূল্যবৃদ্ধির আলোচনাকে ছাপিয়ে রুটি-বিস্কুটের দাম আর সরবরাহ সংকটের কথা এখন মুখে মুখে।
মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়ার দোকানি শফিকুল জানান, ১০ টাকার রুটি এখন ১৫ টাকা করা হয়েছে, ৫ টাকার বনরুটি কিছুদিন আগে সাত টাকা করা হয় আর এখন তা ১০ টাকা।
এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি গত পাঁচ দিন ধরে কোনো পণ্য দিচ্ছে না। লোকাল কিছু বেকারির পণ্য আসছে কিন্তু তা সব ক্রেতা নিচ্ছে না। এই পরিস্থিতি চলছে গত এক সপ্তাহ ধরে।
মালিবাগ রেলগেটের কাঁচাবাজারের কাছে ফুটপাতে বসে চা বিক্রি করেন কামরুল। তার ক্রেতাদের অধিকাংশই রিকশা আর ঠেলা গাড়ি চালক কিংবা দিনমজুর।
কামরুল বলেন, “সকাল বেলা চা দিয়া একটা ছোট রুটি চুবাইয়া খায় মানুষজন। যে বনরুটি ৬ টাকায় বিক্রি করতাম। এখন সেই রুটি পাওয়া যাইতাছে না। সাপ্লাই নাই।”
তিনি জানান, রিকশা চালকরা কয়েকবার যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে ফুটপাতের দোকানে চা আর বনরুটি খেতে আসে।
“এহন সেই রুটি আমি বিক্রি করতে পারতাছি না। কেমনে ব্যবসা হবে বলেন? সারাদিনের ইনকামও কইমা গেছে এই কয়দিনে। কেমনে সংসার চালামু? মাথায় ধরে না।”
সাধারণ মানুষের ওপর বেকারিপণ্যের এমন মূল্যবৃদ্ধির চাপ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন বলেন, “আমার ভীষণ খারাপ লাগে পরিস্থিতি দেখে।”
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সকালে নারায়ণগঞ্জে একটি টং দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। একজন রিকশাওয়ালাও আমার পাশে বসে চা আর দুটি বনরুটি খেয়েছে।
“টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে সে রীতিমতো ক্ষেপে গেল। চা আর রুটিতেই তার চলে গেছে ৩০ টাকা। ১৫ টাকার মধ্যে তার নাস্তা সারার ইচ্ছা ছিল। আমাদের এসব বেকারিপণ্য গরিব-মেহেনতি মানুষই বেশি খায়।”
জালাল উদ্দিন বলেন, “কিন্তু দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই। ময়দা, তেল, ডালডাসহ প্রায় সব ধরনের কাঁচামালের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। চিনির দামও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা কেবল টিকে থাকার জন্য এমন দাম বাড়িয়েছি।
“কাঁচামালের দাম আরেক দফায় বাড়লে আর দামও বাড়ানো যাবে না। কারণ বাজার ইতোমধ্যেই নতুন মূল্য তালিকা মেনে নিতে পারছে না। সুতরাং হাজার হাজার বেকারি বন্ধ হয়ে যাবে। ১০ লাখ মানুষ বেকার হবে।”
কনফেকশনারি দোকান মালিকদের এই নেতা জানান, গত ১ জুন থেকে সব পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে ২০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি করেছি। ফলে সব ধরনের পণ্যের দামই কমবেশি বেড়েছে।
“৪০ গ্রামের বনরুটি চলতি বছরের শুরুতে ৫ টাকা থেকে ৭ টাকা হয়েছিল। সেই দামটা এখন ১০ টাকা করা হয়েছে। স্লাইস কেক এর দাম ১০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫ টাকা হয়েছে।
“কিছু কিছু পণ্যের দাম ৭ টাকা থেকে বেড়ে ৮ টাকা হয়েছে, ৬ টাকা থেকে বেড়ে ৭ টাকা হয়েছে। দাম বৃদ্ধির কারণে প্রাথমিক অবস্থায় বিক্রি কিছুটা কমে গেছে।”
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে অতীতে কখনও বেকারিপণ্যে এতটা মূল্যবৃদ্ধি হয়নি বলে স্বীকার করেন জালাল উদ্দিন।
“এবার স্মরণকালের সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। ২০০২ সালের জানুয়ারিতে একবার দাম বেড়েছিল। হয়ত ৫ থেকে ৭ শতাংশ হবে। অতীতে দেখিনি একসাথে এত দাম বাড়তে। ময়দার দাম আগে কখনও ডাবল হতে দেখিনি।
“রোজায় ময়দা ছিল ৫০ কেজির বস্তা ১৫০০ টাকা, গতকাল সেটা বিক্রি হয়েছে ৩২০০ টাকায়। পাম তেলের ড্রাম যেটা ১৭ হাজার টাকা ছিল সেটা ৩১ থেকে ৩২ হাজার টাকায় উঠেছে। চিনির বস্তা ৩৬০০ থেকে বেড়ে ৪০০০ টাকা হয়েছে।”
মিরপুর শেওড়াপাড়ার ‘জাশান বেকারি’র ব্যবস্থাপক সাইদুল ইসলাম জানান, “তাদের সব ধরনের বনরুটির দাম গত এক সপ্তাহ ধরে ৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। এতে তাদের বিক্রি অনেক কমে গেছে।
৩৫ টাকার রুটি এখন ৪০ টাকায়, ২০ টাকা দামের রুটি ২৫ টাকায় এবং ৩০ টাকার রুটি ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমাদের কারখানায় প্রতিদিন অন্তত ১০ বস্তা ময়দার পণ্য বিক্রি করা যেত। সেখানে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ৭ বস্তার বেশি ময়দা খরচ হচ্ছে না। পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
“ময়দার কেজি ৪২ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। ডালডার দাম ১৬ কেজির কার্টুন ২৬০০ থেকে বেড়ে ৩৬০০ হয়েছে। পাম তেল, ইস্ট ও প্যাকেজিংয়ের পলিথিনের দামও বেড়েছে।”
৫০ পয়সার বাটারবন ৪০ বছরে ১৫ টাকা
রাজধানীর পুরান ঢাকায় চার পুরুষ ধরে বেকারিপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত আছেন জালাল উদ্দিন। সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির কথা বলতে গিয়ে ৪০ বছর আগে বাবার হাত ধরে বেকারি ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
“১৯৮১ সালের দিকে প্রথম যখন ব্যবসায় ঢুকি প্যাটিস ছিল ৩০ পয়সা। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে ৬ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। জুন থেকে সেটা হচ্ছে ১০ টাকা। পিছ কেকের দাম ছিল ৪০ পয়সা থেকে ৪৫ পয়সা। যেটা এখন ১৫ টাকা।
“৪০ বছর আগে ৪০০ গ্রাম বা এক পাউন্ড এবং ২০০ গ্রাম বা আধা পাউন্ডের রুটি ছিল। এখন ৮০০ গ্রাম বা দুই পাউন্ডের রুটিও পাওয়া যায়। তখন হাফ পাউন্ড রুটির দাম ছিল ১ টাকা ২৫ পয়সা আর ফুল পাউন্ড ১ টাকা ৬০ পয়সা।”
তিনি জানান, এখন ৫০ থেকে ৬০ গ্রামের যে বাটারবন ১০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫ টাকা হল, সেটা আশির দশকে ৪০ থেকে ৫০ পয়সা করে বিক্রি হত। ওজনেও ছিল ১২০ গ্রাম।
গত এক দশক ধরে তা ১০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “একটা খেলে টিফিনের কাজ সেরে যেত।”
২০০২ সালের দিকে বেকারি পণ্যে বড় ধরনের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে, তাও ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি নয়। ওই সময় বন রুটির দাম ৪ টাকা থেকে বেড়ে ৫ টাকা হয়, ওভাবেই প্রায় ২০ বছর ধরে বিক্রি হচ্ছিল আর এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়।
সেসময় ফুল পাউন্ড রুটির দাম ছিল ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা। হাফ পাউন্ড ৮ টাকা থেকে ১০ টাকা। আর এখন ফুল পাউন্ড হয়েছে ৫০ টাকা। বিস্কুটের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। এখন বিস্কুটের কেজি ১৪০ টাকা।