বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি তা ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে; যদিও শুনানিতে এই দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছে ক্যাব ও ব্যবসায়ী নেতারা।
মহামারী ও ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধির মধ্যে পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে খুচরায়ও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কারিগরি কমিটির এই সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে বিইআরসি। কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল স্বীকার করেছেন, পাইকারি দাম ঘোষণা হলে খুচরায় তার প্রভাব পড়বে।
পাইকারি বিদ্যুতের একমাত্র ক্রেতা ও বিক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনে বিতরণকারী সংস্থাগুলো।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে আসছে বাম দলগুলো। ফাইল ছবি
সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন খুচরায়ও দাম বেড়েছিল।
তখন পাইকারিতে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য ৪০ পয়সা করে বাড়িয়ে (৮ দশমিক ৪ শতাংশ) ৫ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও পাইকারি দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে সরকার ৪৭ পয়সা ভর্তুকি দেওয়া শুরু করে।
দুই বছর পর পিডিবি ‘ভর্তুকির ধারা থেকে মুক্ত হতে’ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিদ্যমান মূল্যহার ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৬ পয়সা করার প্রস্তাব করে।
তাদের সেই প্রস্তাব নিয়ে বুধবার বিইআরসিতে শুনানি হয়। শুনানি শেষে কারিগরি কমিটির বিশ্লেষণে মূল্যহার প্রস্তাবের চেয়ে ৪০ পয়সা কমিয়ে ৮ টাকা ১৬ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়।
তাতে বিদ্যমান দরের চেয়ে দাম বাড়ছে ৫৮ শতাংশ। তবে সরকার ভর্তুকি দিলে তা যে পরিমাণে দেবে, সে পরিমাণে সমন্বয় করে দাম ঠিক করা যাবে বলেও শুনানিতে জানানো হয়।
মূল্যায়ন কমিটির হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ হাজার ১৯৪ কোটি ৯০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা-কোম্পানিগুলোর কাছে সরবরাহ করতে হবে পিডিবিকে। এ জন্য এক বছরে পিডিবির দরকার হবে ৬৬ হাজার ৮৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বিদ্যমান দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হলে এক বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি থাকবে। ঘাটতি না রাখতে হলে পিডিবিকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ১৬ পয়সায় বিক্রি করতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার ভর্তুকি দিলে পাইকারি মূল্যহার কমবে। যে হারে ভর্তুকি দেবে সে হারে মূল্যহার কমবে।
শুনানিতে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ‘অযৌক্তিক ও অন্যায্য’ হবে। বরং অপচয়, সিস্টেম লস এবং সরকারের করের পরিমাণ কমিয়ে এবং দুর্নীতি দূর করে গ্রাহককে সহনীয় এবং ন্যায্য দরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়।
১১ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১১৮ শতাংশ: ক্যাব
বিদ্যুতের অপচয়। ঢাকার বিজয় সরণি মোড়ে সড়ক বাতিগুলো সম্প্রতি দুপুরে প্রখর রোদের মধ্যেও জ্বলতে দেখা যাচ্ছিল। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
তিনি ক্যাবের পক্ষে সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, “পাইকারি বিদ্যুতের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি সমন্বয়ে মূল্যহার বাড়ানো কিংবা ভর্তুকি দিতে হবে না। বরং অন্যায়, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়বৃদ্ধি বন্ধ করলেই চলবে। সরকার যদি ৬ শতাংশ ট্যাক্স নতুনভাবে আরোপ না করে, জ্বালানি তেলে শুল্ক-কর অব্যাহতি সুবিধা পুনর্বহাল করে, কয়লার ওপর ৫ শতাংশ নতুনভাবে আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত তেল ব্যক্তি খাতের পরিবর্তে বিপিসির মাধ্যমে আমদানি করে তাহলে ৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা ঘাটতি কমানো যাবে।”
ক্যাব সহ-সভাপতি শামসুল হিসাব দেন, এর সঙ্গে ‘অবৈধভাবে’ নির্ধারিত ডিজেল ও ফার্নেস তেলের বর্ধিত দাম এবং কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ ‘অবৈধভাবে’ ক্রয়কৃত মূল্য পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহারে সমন্বয় না করে ঘাটতি ১৪ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করা যাবে। পিডিবির কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ৫৩ শতাংশের পরিবর্তে ৬৭ শতাংশ পিএফ-এ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ঘাটতি ১৫ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা, ১৩২ কেভি ও এর বেশি ভোল্টেজ লেভেলের ভোক্তাদের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার ভর্তুকিমুক্ত করে এবং বিতরণ সংস্থাভেদে তা অভিন্ন করে ঘাটতি ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা এবং ১৯টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ক্ষেত্রে পাইকারি দাম ‘যৌক্তিক’ করে ঘাটতি ৩ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা কমানো যাবে।
শুনানিতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবুও পিডিবি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক প্রভাব যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়নি। এই আবেদন অযৌক্তিক। বর্তমান চলমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আলোচ্য প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের জন্য একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।”