গোপন ‘স্পাই ওয়্যারলেস’ কিটের মাধ্যমে পরীক্ষা কেন্দ্রের
বাইরে প্রশ্ন পাঠিয়ে এভাবে উত্তর সরবরাহের মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে একটি
চক্র ‘কোটি টাকা’ হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
অভিনব এ প্রতারণার
ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে
বিস্তারিত জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তাররা হলেন-
মো. ইকবাল হোসেন (৪২), রমিজ মৃধা (৩০), মো. নজরুল ইসলাম (৫০), ও মো. মোদাচ্ছের হোসেন
(৬২)।
ঢাকা ও তার আশেপাশের
এলাকা থেকে বুধবার রাতে তাদের গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়ে খন্দকার মঈন বলেন, সংঘবদ্ধ
এ প্রতারক চক্রটি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করত।
“চক্রটি এজন্য ‘হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট’ ব্যবহার করত। এভাবে বিভিন্ন নিয়োগ
পরীক্ষায় উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দিয়ে চাকরী প্রার্থী এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে
কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।”
২০ মে দ্বিতীয় ধাপে
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রতারক চক্রগুলো
তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে জানান আল মঈন।
তিনি বলেন, “তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি
নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে ওই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার
স্থান ও পরীক্ষার গার্ড সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করত।
“চক্রের অন্য সদস্যরা দেশের বিভিন্ন
অঞ্চলের সরকারি বা বেসরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের খুঁজে বের করে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার
বিনিময়ে উত্তীর্ণ ও চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখান।”
গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক
জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য তুলে ধরে এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, আগ্রহী পরীক্ষার্থীদের ডিজিটাল
ডিভাইসগুলো ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রাথমিকভাবে ১/২ লাখ টাকা জামানত হিসেবে নেওয়া
হত।
অবশিষ্ট টাকা চাকরি
পাওয়ার পরে পরিশোধের চুক্তি করত। এভাবে তারা কয়েক বছর ধরে চাকরি প্রার্থীদের কাছ
থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানান র্যাব কর্মকর্তা।
“এভাবে তারা কয়েক বছর ধরে চাকরি
প্রার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে,”- বলেন কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, প্রতারণায়
ব্যবহার করা ডিজিটাল ডিভাইসগুলো বিদেশ থেকে আনা এবং মূলত দুটি অংশে বিভক্ত।
“ডিভাইসটির একটি অংশ ইয়ার পিস,
যা কানের ভেতরে দেওয়া হয়। অটোমেটিক কল রিসিভ হওয়া সিম লাগানো অপর অংশটি শরীরের বিভিন্ন
স্থানে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে তাদের পরীক্ষার হলে পাঠানো হয়।
“পরবর্তীতে পরীক্ষার্থীরা প্রশ্ন
বাইরে পাঠাতেন। প্রতারক চক্রটি প্রশ্নপত্রের উত্তর দেওয়ার জন্য আগে থেকেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের
সমন্বয়ে একটি টিম প্রস্তুত রাখত। ওই টিম উত্তর বলে দিত চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের।”
র্যাব জানায়, প্রতারক
চক্রের প্রধান ইকবাল হোসেন ২০০৮ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে
নিয়োগ পান। নিজ এলাকায় শিক্ষকতার সময় ২০১৫ সালে একই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী
আলতাফ হোসেন নামের একজনের মাধ্যমে এই চক্রে যুক্ত হন।
পরবর্তীতে করোনাভাইরাস
মহামারীর সময় আলতাফ হোসেন মারা গেলে ইকবাল হোসেন এই প্রতারক চক্রটির পরিচালনা শুরু
করেন বলে জানান র্যাব কর্মকর্তা মঈন।
“তার বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া
থানায় একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা ও বেশ কয়েকটি সাধরণ ডায়েরি
রয়েছে।”
রমিজ এই প্রতারক
চক্রের অন্যতম সহযোগী এবং একটি হত্যা মামলার পলাতক আসামি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো
হয়।
তাকে জিজ্ঞাসাবাদের
উল্লেখ করে র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে থাকার সময় ২০২০ সালে চক্রের প্রধান
ইকবালের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেসময় রমিজ তার আর্থিক সংকটের কথা ইকবালকে খুলে বলেন
এবং বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস সম্পর্কে ভালো অভিজ্ঞতা আছে বলে জানান।
“ইকবাল তাকে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায়
সহযোগিতা করার কথা বলে প্রতারক চক্রের সদস্য করে নেন। ডিজিটাল ডিভাইস সম্পর্কে ইকবালের
জ্ঞান কম থাকায় তিনি রমিজকে দিয়ে এই কাজ সম্পাদন করতেন।”
তিনি বলেন, “যখন কোনো সরকারি নিয়োগ পরীক্ষা
হত, তারা তখন পরিক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত করে কেন্দ্রের
বাইরে অবস্থান করতেন। রমিজের পরিচিত কিছু মেধাবী ছাত্রের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে ডিজিটাল
ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর জানিয়ে দেওয়া হত।”
গ্রেপ্তার নজরুল
ইসলাম ১৯৯৪ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরে অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগ দেন
বলে জানায় র্যাব।
কমান্ডার মঈন বলেন,
“নজরুল এবং রমিজের বাড়ি পাশাপাশি
হওয়ায় তারা একে অপরের পূর্বপরিচিত ছিল। চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের
সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠে নজরুলের।
“এই সুযোগে সে দেশের বিভিন্ন এলাকার
মানুষকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের ইকবাল ও রমিজের সঙ্গে যোগাযোগ
করিয়ে দিতেন। এছাড়া নজরুল বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার সময়, স্থান ও পরীক্ষার গার্ড
খুঁজে বের করার দায়িত্ব পালন করতেন।”
গ্রেপ্তার মোদাচ্ছের
মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার সমাজসেবা কার্যালয় থেকে সমাজসেবাকর্মী হিসেবে ২০১৯
সালে অবসর নেন।
র্যাব জানায়, তিনি
ইকবালের ঘনিষ্ঠ হিসাবে কাজ করতেন। এই চক্রে তিনি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেওয়ার
কথা বলে চাকরি প্রার্থীদের খুঁজে বের করে ইকবাল ও রমিজের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন।
গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে
আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানায় র্যাব।