ক্যাটাগরি

একুশের সেই অবিনাশী গান যেভাবে এল

তিনি লেখেন এক অমর কবিতা: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। প্রথমে আব্দুল লতিফ ও পরে আলতাফ মাহমুদের সুরে সেই কবিতা হয় গান।

বাংলা ভাষা, ভাষা আন্দোলন আর বাঙালির ইতিহাসে অমর হয়ে যাওয়া সেই গান সৃষ্টির গল্প এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সাংবাদিক, কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। সেদিন ডাকা হয় ধর্মঘট। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।

সেদিন ১৪৪ ধারা ভেঙে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় বাংলা মায়ের দামাল সন্তারেরা। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চলে; শহীদ হন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, শফিউদ্দীন, সালামসহ আরও অনেকে।

ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে গিয়েছিলেন তখনকার ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী। মেডিকেলের বহির্বিভাগে তিনি ভাষা সংগ্রামী রফিকের মাথার খুলি উড়ে যাওয়া লাশ দেখতে পান।

লাশটি দেখে তার বারবার মনে হতে থাকে, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তখনই তার মাথায় আসে একটি লাইন, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।”

এরপর ইতিহাস হয়ে যায় সেই কবিতা। যাতে সুর করেন আলতাফ মাহমুদ। হয়ে ওঠে বাঙালির ভাষার গান, যা পরে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।

আব্দুল গাফফার চৌধুরী

গাফফার চৌধুরী বলেছিলেন, “রফিকের নিথর দেহ পড়ে আছে। মাথার খুলি নেই। মনে হচ্ছে যেন আমার ভাই পড়ে আছে। তখন হঠাৎ করেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এই লাইন মুখে চলে আসে। গানটি লিখতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। গানটা এমন সময় লিখেছিলাম নিজের অজান্তেই।”

২২ ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে গায়েবি জানাজা হয়। জানাজা শেষ হওয়ার পর শুরু হয় গণমিছিল, গাফফার চৌধুরী সেদিন পুলিশের পিটুনিতে আহত হন।

ওই অবস্থাতেই কবিতার পরের লাইনগুলো লিখতে শুরু করেন গাফফার চৌধুরী। এরপর গেন্ডারিয়ায় গোপন এক সভায় একটি ইশতেহার প্রকাশ করা হয়। সেই ইশতেহারেই প্রথম কবিতাটি ছাপানো হয়।

প্রথমে আবদুল লতিফ সেই কবিতায় সুরারোপ করেন; ১৯৫৩ সালে গুলিস্তানের ব্রিটেনিয়া হলে ঢাকা কলেজের নব নির্বাচিত ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে গানটি প্রথম পরিবেশন করা হয়।  

১৯৫৩ সালের মার্চে হাসান হাফিজুর রহমান ‘একুশে সংকলনে’ এটি প্রকাশ করেন; কিন্তু পাকিস্তান সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।

পরে গানটিতে সুরারোপ করেন আলতাফ মাহমুদ, সেই সুরেই ১৯৫৪ সালে গানটি প্রভাতফেরিতে প্রথম গাওয়া হয়।

এখন প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেই অবিনাশী গান কণ্ঠে নিয়ে প্রভাতফেরিতে যায় বাংলাদেশের মানুষ। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এর অবস্থান তৃতীয়।

১৯৭০ সালে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তার বিখ্যাত সিনেমা ‘জীবন থেকে নেওয়া’তে গানটি ব্যবহার করেছিলেন। হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১৫টি ভাষায় এখন গাওয়া হয় একুশের গান।

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবসে ফুলে ফুলে ছাওয়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

‘একুশের গান’ হিসেবে এখন গাওয়া হয় গাফফার চৌধুরীর সেই কবিতার প্রথম ছয় লাইন। পুরো কবিতাটি ৩০ লাইনের।

 

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি।।

 

জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা

শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,

দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী

দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?

না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

 

সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে

রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;

পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,

এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।

 

সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,

তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা

ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে

ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে

ওরা এদেশের নয়,

দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়

ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।

 

তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি

আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী

আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে

জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে

দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।