রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, “আমাদের পরিষ্কার ঘোষণা, আমরা সরকার গঠন করলে মুক্ত গণমাধ্যমের অন্তরায় ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’সহ সকল ধরনের নিবর্তনমূলক আইন ও অধ্যাদেশ বাতিল করব।
“গণমাধ্যমে প্রকাশিত যে কোনো বিষয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা সংস্থা প্রেস কাউন্সিলে ফয়সালা না করে কোনোভাবেই যেন আদালতে মামলা দায়ের করতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করা হবে।”
‘গণতন্ত্র হত্যায় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই মতবিনিময় সভা করে বিএনপি। এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও অংশ নেন।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন।
মূল প্রবন্ধে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার’ প্রকাশিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনমনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, “এর পেছনে নিবর্তনমূলক আইন ও অধ্যাদেশগুলোকে দায়ী। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, আইসিটি অ্যাক্ট, দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস-২০১২, ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও নীতিমালা-২০২১, অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট প্রভৃতির মাধ্যমে গণমাধ্যমকে এমনভাবে চেপে ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছে যে তারা শুধুসরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
“মামলা ও হয়রানির ভয়ে বেশিরভাগ মিডিয়া সেল্ফ সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন বণ্টনের বৈষম্য, বেতন বোর্ড বাস্তবায়নে মালিকপক্ষের অনীহা প্রভৃতি কারণে বেশির ভাগ গণমাধ্যমকর্মীকে চরম আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ফলে সৎ ও মেধাবী সাংবাদিকরা ধীরে ধীরে এই পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।”
অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, “বিএনপির পক্ষ থেকে একটা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে কিছু অঙ্গীকার করা হয়েছে। তাদের অঙ্গীকারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে পারি, আশ্বস্ত হওয়ারও চেষ্টা করতে পারি।
“কিন্তু আমাদের অতীত আশ্বস্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি নয়, বর্তমান তো নয়ই। স্বাধীনতার পর থেকে কোনো সরকারই সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমবান্ধব ছিল না, এখনও নেই।”
বিএনপির আমলে জহুর হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কারাগারে নিয়ে যাওয়া, একুশে টিভি বন্ধ করে দেওয়া, বিভিন্ন মতের পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপন কমিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন উদাহরণও তিনি টানেন।
সোহরাব হোসেন বলেন, “আজকে আওয়ামী লীগ যা করছে, তা সমর্থন করছি, সেটি নয়। অবশ্যই মুক্ত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে, মত প্রকাশের ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো আছে সেক্ষেত্রে বিরোধী দলের সমর্থন চাই, সহযোগিতা চাই। কিন্তু একসঙ্গে এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে চাই, তারা ক্ষমতায় গেলে যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।”
জ্যেষ্ঠ এ সাংবাদিক বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে- খুবই নিবর্তনমূলক আইন করেছে। এটি স্বৈরাচারী আইন। এর নিন্দা করি, প্রত্যাহারের দাবি জানাই। কিন্তু আইসিটি আইন যেটি সংশোধন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালে, সেই আইনটি কিন্তু প্রথম চালু করা হয়েছিল বিএনপির আমলেই। শাস্তিটা আওয়ামী লীগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
“আমাদের সরকারি কাঠামোয় আমি জানি না এটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন নাকি আমাদের প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয়। প্রশাসন নিজেকে রক্ষা করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কীভাবে প্রভাবিত করে, কেনো প্রভাবিত করে এবং সেটি এখনকার বাস্তব অবস্থায় নিশ্চয়ই আপনারা জানেন। আমরা যে কথাটি বলতে চাই, আমরা যেন সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে পারি, সবসময় বলতে পারি।”
সাংবাদিক সোহরাব হোসেনের দেওয়া বক্তব্য খণ্ডন করে বিএফইউজের সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন, “সোহরাব ভাই সঠিক তথ্য দেননি। সাংবাদিক জহুর হোসেন কারাগারে যাননি। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। একুশে টিভি বিএনপি সরকার বন্ধ করেনি। এটি টেরেস্টোরিয়াল সম্প্রচারের ইস্যুতে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে বন্ধ হয়েছে।”
একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের আমলে সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা দায়েরসহ সারাদেশে সাংবাদিকদের নির্যাতনের চিত্রও তুলে ধরেন বিএফইউজের একাংশের এই শীর্ষনেতা।
দেশের গণমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে যুগান্তরের জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক মাহবুব কামাল বলেন, “বাংলাদেশের প্রেসের অবস্থা খুবই মারাত্মক। এর কারণটা হচ্ছে উইপেন অব ‘ল অর্থ্যাৎ আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।
“বাংলাদেশে অসংখ্য আইন আছে, যা আমাদের দেশে স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যমের পরিপন্থি.. , প্রত্যেকটি আইন সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের জন্য পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে হুমকি স্বরূপ।”
মতবিনিময় সভার সভাপতি বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেন, “গণমাধ্যমকে স্বাবলম্বী করার জন্য বিএনপি বিজ্ঞাপনের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করবে। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট সংখ্যক প্রকাশনা, প্রচারণা কিংবা টিআরপির ভিত্তিতে গণমাধ্যমগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার চিন্তাও বিএনপির রয়েছে।
“দেশের ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বিজ্ঞাপন প্রদানের ক্ষেত্রে দেশীয় গণমাধ্যমগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়, সেটি নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও আমাদের (বিএনপি) রয়েছে।”
সাংবাদিকদের ওয়্জে বোর্ড সব সংবাদমাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও করেন বিএনপি মহাসচিব।
দেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, “আজকে গোটা জাতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে, বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই জাতি বা রাষ্ট্রকে উদ্ধার করতে হলে একটা ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য সকল জনগণের মধ্যে মধ্যে সৃষ্টি করতে আমরা যদি না পারি, তাহলে এখান থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো পথ নেই।
“সেজন্য আমাদের সকলের দায়িত্ব, সাংবাদিকরা তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন, রাজনীতিবিদরা তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন- এর মধ্যে একটা ঐক্য সৃষ্টি করে আমরা যেন দেশে গণতন্ত্রকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আনতে পারি, সেই উদ্যোগটা গ্রহণ করা উচিত।”
ক্ষমতার পরিবর্তনে আশাবাদী ফখরুল বলেন, “টানেলের পেছনে আলো দেখছি বলেই পুনরায় আমরা উৎসাহিত বা উৎফুল্ল হচ্ছি, তাই নয়; আমরা সব সময়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবার জন্য কাজ করেছি, কাজ করে যাচ্ছি। সরকারে যখন ছিলাম তখনও করেছি, সরকারে নেই এখনও গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছি।”
বিএনপি নেতা শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির সঞ্চালনায় এই সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৭ মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্ত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, দিনকালের সম্পাদক রেজোয়ান সিদ্দিকী, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার, এম এ আজিজ, নুরুল আমিন রোকন, এলাহী নেওয়াজ খান সাজু, কামাল উদ্দিন সবুজ, বাকের হোসাইন, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, সরদার ফরিদ আহমদ, কাদের গনি চৌধুরী, ইলিয়াস খান, শহীদুল ইসলাম, ইলিয়াস হোসেন, রফিকুল ইসলাম আজাদ, মুরসালিন নোমানী, শফিক আহমেদ।
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু উপস্থিত ছিলেন।