আইন বলছে, ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের বেশি কারাদণ্ড হলে সংসদ সদস্য
পদের যোগ্যতা আর থাকে না।
তবে ক্ষমতাসীন দলের হাজি সেলিমের ক্ষেত্রে এখনই সিদ্ধান্ত টানতে
নারাজ সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, তার আপিল করার সুযোগ তো এখনও
আছে।
আর হাজি সেলিমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তা আনুষ্ঠানিকভাবে
জানতে হবে আইনসভা বা সংসদকে। তা এখনও জানেননি বলে জানালেন স্পিকার শিরীন শারমিন
চৌধুরী।
পুরান ঢাকার লালবাগসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৭ আসনে হাজি
সেলিম এ নিয়ে তৃতীয়বার সংসদ সদস্যের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী
লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
ওয়ার্ড কমিশনার হাজি সেলিম ১৯৯৬ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন করেই
বিজয়ী হন। পরের বার হারেন বিএনপির নাসিরউদ্দিন পিন্টুর কাছে।
এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পুনরায় এমপি হলেও সেনা নিয়ন্ত্রিত
তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডের কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি
অংশ নিতে পারেননি।
সেই মামলাটি হাই কোর্টে বাতিলের ফলে পরের দুটি নির্বাচনে অংশ নিতে
পারলেও আপিল বিভাগ পুনর্বিচারের আদেশ দেওয়ার পর রায় বদলে যাওয়া হাজি সেলিমকে ফেলল
সঙ্কটে।
দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত পুরান ঢাকার সংসদ সদস্য হাজি সেলিম রোববার আত্মসমর্পণ করতে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে হাজির হন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
এই মামলাটি দায়ের করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন, ২০০৭ সালের ২৪
অক্টোবর। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জরুরি অবস্থার মধ্যেই পরের বছরের
২৭ এপ্রিল বিচারিক আদালত রায় দেয়।
রায়ে দুটি ধারায় মোট ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় হাজি সেলিমকে। অবৈধ
সম্পদ অর্জনের জন্য ১০ বছর কারাদণ্ড, আর সম্পদের তথ্য গোপন করায় ৩ বছর। তাকে সহযোগিতা করায় স্ত্রী গুলশান আরা বেগমকেও ৩
বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
হাজি সেলিম এবং তার স্ত্রী ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করলে
২০১১ সালের ২ জানুয়ারি উচ্চ আদালত তাদের সাজা বাতিল করে রায় দেয়।
দুদক তখন সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে। ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৫
সালের ১২ জানুয়ারি হাই কোর্টের রায় বাতিল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে হাজি সেলিমের আপিল
পুনরায় হাই কোর্টে শুনানির নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ।
সেই শুনানি শেষে গত বছরের ৯ মার্চ হাই কোর্ট বেঞ্চ একটি ধারায় হাজি
সেলিমের ১০ বছরের সাজা বহাল রাখে, তবে অন্য ধারায় ৩ বছরের সাজা থেকে তাকে অব্যাহতি
দেয়। গুলশান আরা মারা যাওয়ায় তার আপিলটি বাতিল করা হয়।
ওই বেঞ্চের দুই বিচারক মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিচারপতি এ কে এম
জহিরুল হকের স্বাক্ষরের পর ৬৮ পৃষ্ঠার রায়ের কপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে হাজি
সেলিমকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়।
এরপর তিনি বিদেশ গেলে পালানোর গুঞ্জন ছড়ালেও তা চাপা দিয়ে তিনি দেশে
ফিরে রোববার ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ঢাকার ৭ নম্বর বিশেষ জজ
আদালতের বিচারক শহীদুল ইসলাম তার জামিন আবেদন নাকচ করে দেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া
হয় কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
আইনপ্রণেতা হাজি সেলিম দণ্ড নিয়ে কারাগারে
হাই কোর্ট হাজি সেলিমকে ১০ বছরের সাজা দেওয়ার সময়ই দুদকের আইনজীবী
খুরশীদ আলম খান বলেছিলেন, নৈতিক স্খলনে দণ্ডিত হওয়ায় এই রাজনীতিক সংসদ সদস্য পদে
থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
তবে তার আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেছিলেন, সর্বোচ্চ আদালতে এ
মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাজি সেলিমের সংসদ সদস্য পদ থাকবে বলে
তার ধারণা।
আলোচনার মধ্যেই দেশে ফিরলেন হাজী সেলিম
তথ্য গোপন: হাজী সেলিমের শাস্তি চেয়ে দুদকের আপিল
দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত পুরান ঢাকার সংসদ সদস্য হাজি সেলিম রোববার আত্মসমর্পণ করার পর কারাগারে পাঠায় আদালত। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
কী আছে সংবিধানে
বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো
ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর
পর্যন্ত তিনি আর সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন না।
কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ-সদস্য থাকার
যোগ্য হবেন না, যদি-
(ক) কোনো উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করে
(খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় হতে অব্যাহতি না পেয়ে থাকেন
(গ) তিনি যদি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন
বিদেশশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন
(ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে
অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং মুক্তির পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়ে
থাকে
জাতীয় সংসদ ভবন। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
সংসদ কী করবে?
কোনো সংসদ সদস্য গ্রেপ্তার, আটক বা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে বা মুক্তি
পেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী তা স্পিকারকে জানাতে
হয়। স্পিকার জানার পর তা সংসদকে জানান।
তবে রোববার পর্যন্ত হাজি সেলিমের রায়ের বিষয়ে সংসদকে আনুষ্ঠানিক
কোনো কর্তৃপক্ষ কিছু জানায়নি।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায়
বলেন, “আমরা রায়ের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক
কিছু জানি না। সেটা জানা গেলে তখন পরের আলোচনার বিষয় উঠবে।”
সংসদ সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “হাজি
সেলিমের বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু বলার সময় এখনও আসেনি। তিনি আপিল করতে পারেন। উচ্চ
আদালতে জামিন চাইতে পারেন। সেগুলোর নিষ্পত্তি হওয়ার আগে সদস্যপদ নিয়ে কিছু বলার
সময় আসেনি।
“তাছাড়া নিয়ম আছে যে, সংসদ সদস্য পদ নিয়ে কোনো
বিতর্ক দেখা দিলে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।”
বর্তমান সংসদে এর আগে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল
কুয়েতের আদালতে দণ্ডিত হলে তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল সংসদই।
অর্থ ও মানবপাচার এবং ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে ২০২০ সালের জুনে কুয়েতে
গ্রেপ্তার হন পাপুল। ওই মামলার বিচার শেষে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি তাকে চার বছরের
সশ্রম কারাদণ্ড দেয় কুয়েতের একটি আদালত। পরে সেদিন থেকেই তার সংসদ সদস্য পদ শূন্য
ঘোষণা করা হয়েছিল।