এরই মধ্য পানি কমতে শুরু করায় এসব এলাকার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে নদ-নদীর চারটি পয়েন্টে এখনও বিপদসীমার ওপরে বয়ে যাচ্ছে পানি।
উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণে গেল সপ্তাহ ধরে উত্তর পূর্বাঞ্চলের নিম্নাঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। বসতবাড়িসহ পানি উঠে যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও।
সোমবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানান, বৃষ্টিপাত কমে আসায় কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক হয়ে উঠবে’।
“উজানে বৃষ্টিপাত কমেছে, আগামী কয়েকদিনও তেমন ভারি বর্ষণের আভাস নেই। এমন পরিস্থিতিতে বন্যার আর অবনতির শঙ্কা নেই। বিরাজমান পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে।”
গত ১৯ মে ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি, আসামের ধুব্রি ও অরুণাচলের পাসিঘাটে ১০০ মিলিমিটার থেকে ২০৪ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। গত তিন দিনে এসব পয়েন্টে বৃষ্টিপাত কমে ৯০ মিলিমিটারে নেমে আসে।
এই কর্মকর্তা জানান, বৃষ্টিপাত কমে আসায় সুরমা নদীর কানাইঘাট, কুশিয়ারার অমলশীদ ও শেওলা, সোমেশ্বরীর কলমাকান্দা পয়েন্টে পানি কমেছে। তবে এখনও তা বিপৎসীমার উপর রয়েছে।
এছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মেঘনার উজানেও নদ-নদীর পানি কমে আসছে। আগামী ৪৮ ঘন্টা তা অব্যাহত থাকবে।
এদিন সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে দশমিক ২০ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার দশমিক ৬৪ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হয়েছে।
অমলশীদ পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি দশমিক ৪২ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার উপরে এবং শেওলা পয়েন্টে দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার দশমিক ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছিল।
এছাড়া নেত্রকোণার কলমাকন্দায় সোমেশ্বরী নদীর পানি দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার দশমিক ১৮ পয়েন্ট ওপরে ছিল বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার কিছু স্থানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয় মঙ্গলবার চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের দুএক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বিজলী চমকানোসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।

চলতি মৌসুমে এপ্রিলের শেষ ভাগে এক দফা এবং মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় দফায় আকস্মিক বন্যার মুখে পড়ে হাওর ও সীমান্তবর্তী উপজেলার নিম্নাঞ্চল।
হঠাৎ আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের ১৩টি উপজেলার ৮৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জের সড়ক ও সেতু ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে কয়েক জায়গায়।
এবারের বন্যায় সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পর এবার বিয়ানীবাজার এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা এবং সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।
এসব এলাকায় সপ্তাহ খানেকের বেশি সময় ধরে দুর্ভোগে পড়ে মানুষ। বিস্তীর্ণ এলাকার রাস্তাঘাট, বসতভিটা প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি পানি উঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও।
বানের তোড়ে অবকাঠামোগত ক্ষতির পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সঙ্কট দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে নানা উদ্যোগও নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
এ মাসে নতুন করে এমন বন্যার শঙ্কা নেই বলে জানান বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী।
এদিকে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বাংলাদেশ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এ বন্যায় ১৫ লাখের বেশি শিশু নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং শিক্ষার ঝুঁকিতে পড়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা ও মৌলভীবাজারের ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
সেখানে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং কৃষিজমি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও স্কুলসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো বন্যায় তলিয়ে গেছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানায় ইউিনিসেফ।
ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে ইতোমধ্যেই ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অন্তত তিনজন শিশু বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি মি. শেলডন ইয়েট এক বিবৃতিতে বলেন, “বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য আমরা সমবেদনা প্রকাশ করছি। অন্য যে কোনো জরুরি পরিস্থিতির মতোই এক্ষেত্রেও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
“এ শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের তাৎক্ষণিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে সরকার এবং অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ইউনিসেফ।”
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বন্যার প্রভাবে শতাধিক স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে শিশুদের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত দুই বছরে ১৮ মাস মহামারীতে স্কুল বন্ধ থাকার পর, আবারও এ ধরনের পরিস্থিতি শিশুদের শিক্ষা বঞ্চিত করছে।
ইউনিসেফ বিশুদ্ধ পানি, হাইজিন উপকরণ, থেরাপিউটিক দুধ ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিটিগুলোর মাঝে পানিতে ডুবে যাওয়া ও জরুরি প্রস্তুতির বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সহায়তা দিচ্ছে।
শিশুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমাজকর্মীরা যাতে প্রস্তুত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের (ডিএসএস) সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানায় ইউনিসেফ।
আরও পড়ুন
সিলেটের ৮ উপজেলা বন্যাকবলিত, সিসিক কর্মচারীদের ছুটি বাতিল