রোববার সন্ধ্যায় ঢাকায় পান্থপথের বাসা থেকে যখন ২৯ বছর বয়সী এই তরুণ কর্মকর্তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হল, ওই কক্ষে একটি চিরকুট পাওয়া গেল; তাতে লেখা – ‘নিদ্রাহীনতায় বাঁচতে পারলাম না’।
পরিবারের সদস্য আর সহকর্মীরা বলছেন, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত দশায় পৌঁছে গিয়েছিলেন মেহেদী, হতাশা থেকে জন্ম নিচ্ছিল নানা জটিলতা, তাতে টুটে গিয়েছিল ঘুম। হয়ত সে কারণেই তিনি বেছে নেন আত্মহননের পথ।
শেরেবাংলা নগর থানার এসআই মতিউর রহমান জানান, কোনো অভিযোগ না থাকায় স্বজন আর সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মেহেদীর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
তিন ভাইয়ের মধ্যে মেহেদী ছিলেন সবার ছোট। মেজ ভাই মনোয়ার হোসেন ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স করে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছেন।
বিডিনিউজি টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মনোয়ার বলেন, গত বছর মার্চ মাসে মারা যান তাদের মা। এরপর থেকে ঘুমাতে পারতেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্সে মাস্টার্স করা মেহেদী।
“ঘুমের জন্য ওকে অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখানো হয়েছে। অনেক কাউন্সেলিং করা হয়েছে। কোনো লাভ হচ্ছিল না। ঘুমের ওষুধ দিলেও একসময় কোনো কাজ হচ্ছিল না। ঘুম না হওয়ার কারণে অনেক ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। এই মে মাসে দুই থেকে তিন ঘণ্টা ঘুম হয়েছে।”
মনোয়ারের ধারণা, ঘুমের ওই সমস্যার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে জমা হতাশাই তার ভাইয়ের জন্য কাল হয়েছে।
শেরেবাংলা নগর থানার এসআই মতিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বজন আর সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে তারাও মেহেদীর তীব্র হতাশার ভোগার কথাই জেনেছেন।
“বেশ সংগ্রাম করে পড়ালেখা শেষ করে সম্প্রতি তিনি চাকরিতে ঢুকেছিলেন। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা মারা গেছেন কিছুদিন হল। মা মারা যাওয়ার পর চাকরি হওয়ায় তার মধ্যে হতাশা আরও বেড়েছিল। সে নাকি বলত, চাকরি পেলে মাকে ভালো রাখবে। কিন্তু সেটা না পেরে হতাশা আরও গভীর হয়।”
বিএসইসির একজন সহকর্মী জানালেন, সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে সহকারী পরিচালক পদেও মনোনীত হয়েছিলেন মেহেদী। আরও দুয়েক জায়গায় তার চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
“মেহেদী খুব মেধাবী ছেলে ছিল। মাকে দেখভাল না করতে পারায় তার মধ্যে একটা হতাশা তৈরি হয়। তার মনে হত, পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে মায়ের সঙ্গে হয়ত অনেক সময় খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে, সেসব নিয়ে কষ্ট পেত। আমাদের কাছে জানতে চাইত, মা তাকে ক্ষমা করবে কি না। আমরা তাকে বলেছি, মা কখনোই সন্তানের প্রতি রাগ করে থাকেন না।”
এক তরুণীর প্রতি দুর্বলতা ছিল মেহেদীর, কিন্তু তাকে বিয়ে করলে সংসার করতে পারবেন কি না- সেই দ্বিধার কথা তিনি সহকর্মীদেরও বলেছেন।
তার ওই সহকর্মী বলেন, মেহেদীর মনের এসব দ্বন্দ্বের কথা তার পরিবারের লোকজনও জানতেন। তারা এসে তাকে বোঝানোর জন্য অনুরোধ করতেন।
“নিজের একের পর এক ভালো চাকরি কীভাবে হচ্ছে, তা নিয়েও এক সময় প্রশ্ন তোলা শুরু করেছিল মেহেদী। এই প্রশ্নও মাঝে-মধ্যে আমাদের করত।
“নিজের প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছিল। বন্ধুদের ভালো সার্কেল তার ছিল না। একাকী থাকতে পছন্দ করত। কাজ শেষে বাসায় ফিরে যেত, বের হত কম।”
মেহেদীর বয়স যখন দেড় বছর, তখন বাবাকে হারান। বাবা কিছু রেখে না যাওয়ায় তিন সন্তানকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়েন মা।
তবে ছোট দুই ছেলের লেখাপড়া তিনি বন্ধ হতে দেননি জানিয়ে মেজভাই মনোয়ার হোসেন বলেন, মোহাম্মদপুরে তাদের বড় ভাইয়ের একটি লন্ড্রির দোকান ছিল পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস। ওই টাকাতেই তাদের লেখাপড়া চলেছে।
“লন্ড্রির পাশেই ছিল আমাদের ভাড়া বাসা। আমি আর মেহেদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হলে থাকতাম। ওর মেধা ছিল আমাদের সবার চেয়ে অন্যরকম।
“মা চলে যাওয়ার পর ওর একটা পর একটা চাকরি হতে থাকল, বিএসইসিতে চাকরির আগে বেপজাতেও চাকরি করেছে। দুদকে মনোনীত হয়েছে। সব মিলিয়ে নয়টা চাকরির অফার ছিল ওর হাতে।”
জীবনে তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে জানিয়ে মনোয়ার বলেন, “এখন সাফল্যর মুখ দেখলো ও। কিন্তু মা তো এসব দেখবে না। তাই নিয়ে মেহেদীর মধ্যে একটা হতাশা কাজ করছিল।”
সোমবার বিকালে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মেহেদীকে দাফন করা হয়েছে বলে জানান মনোয়ার।