ক্যাটাগরি

এমন পরিস্থিতি দেখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি: সিতারা বেগম

এবারের ৫০তম বিজয় দিবস উপলক্ষে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে টেলিফোনে তার কাছে বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি একথা বলেন।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে বসবাসরত সিতারা বলেন, “গত ফেব্রুয়ারিতে দুই সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। সে সময় ঢাকা এবং কিশোরগঞ্জে সময় কাটিয়েছি। সবকিছুই ভালো লেগেছে। মানুষের জীবন-মানের উন্নয়ন ঘটেছে। কেউ না খেয়ে থাকেন না। ছেড়া জামা-কাপড়ও দেখিনি কারো গায়ে। রাস্তার দুই পাশে গাছ-পালাও দেখলাম। সবুজের সমারোহ। পরিবেশ দূষণ রোধে এমন কার্যক্রমের প্রয়োজন রয়েছে।

“তবে গভীর অবলোকনের সময় একটি বিষয় আমাকে হতবাক করেছে। যারা ইতোমধ্যে কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হয়েছেন, তারা আরও টাকা বানাতে চাচ্ছেন। মনে হচ্ছে চাহিদার যেন শেষ নেই। এজন্য কিছু মানুষকে সীমাহীন দুর্নীতিতে লিপ্ত হতে হচ্ছে। এটি আমাকে মনক্ষুন্ন করেছে।”

“কিছু মানুষ এত বেশি ধনী হয়েছেন যা অন্যদের ঈর্ষার কারণ হয়েছে। অপরদিকে, সাদাসিধে মানুষেরা কঠোর শ্রম দিয়েও ততটা ধনী হতে সক্ষম হচ্ছেন না। এটা বিজয়ের চেতনার পরিপন্থি। আমরা এমন পরিস্থিতি দেখার জন্য যুদ্ধে যাইনি, মুক্তিযুদ্ধ করিনি। আশা করছি রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা রয়েছেন তারা এ নিয়ে ভাববেন। তাহলেই স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ পূরণ হবে অতি সহজে।”

কিশোরগঞ্জের আইনজীবী মোহাম্মদ ইসরাইল ও হাকিমুন নেসা দম্পতির সন্তান সিতারা বেগম বৈবাহিক সূত্রে ‘সিতারা রহমান’ হয়েছেন। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের ভেতর তিনি তৃতীয়। বাবার সঙ্গে কিশোরগঞ্জে সিতারা বেগম শৈশব কাটান। সেখান থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর ঢাকায় হলিক্রস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।

সেখান থেকে পাশ করার পর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেলে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোতে সিতারা বেগম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। সে সময় তার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর এ টি এম হায়দার পাকিস্তান থেকে কুমিল্লায় বদলি হয়ে আসেন। তিনি কুমিল্লার তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নে যোগ দেন।

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিতারা ও তার ভাই হায়দার ঈদের ছুটি কাটাতে তাদের কিশোরগঞ্জের বাড়িতে যান। কিন্তু সে সময়ে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। হায়দার তার বোনকে ক্যান্টনমেন্টে আর ফিরে না যাবার জন্য পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে তিনি তার বোন সিতারা, বাবা-মা ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ভারতে পাঠিয়ে দেন। কিশোরগঞ্জ থেকে মেঘালয়ে পৌঁছাতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগে যায়।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ভারতের মেলাঘরে ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ নামে ৪৮০ শয্যার একটি হাসপাতাল ছিলো। ঢাকা মেডিকেলের শেষ বর্ষের অনেক ছাত্র সেখানে কাজ করতেন। ক্যাপ্টেন ও চিকিৎসক সিতারা সেক্টর-২ এর অধীনে সেই হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। তাকে নিয়মিত আগরতলা থেকে ওষুধ আনার কাজ করতে হতো। হাসপাতালে একটি অপারেশন থিয়েটার ছিলো। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বাঙালি ছাড়াও সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোকজন চিকিৎসা-সেবা নিতেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিতারা বেগম রেডিওতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সংবাদ শুনে ঢাকা ফেরেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে প্রতিরোধের চেষ্টা করায় তার সেই ভাই মেজর হায়দার নিহত হন।

জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা এবং নিজের ভাইকেও হারানোর ব্যথায় সিতারা ও তার পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রে এবং স্থায়ীভাবে রয়েছেন। তবে দেশের প্রতি রয়েছে তার গভীর মমত্ববোধ। সে তাগিদে প্রতি বছরই স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবিদুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে যান। শুধু অবকাশ নয়, একই সময়ে ঢাকায় হৃদরোগীদের চিকিৎসা-ক্যাম্পও পরিচালনা করেন। গত ফেব্রুয়ারিতেও তাই করেছেন এ চিকিৎসক দম্পতি।

সিতারা আক্ষেপ করে বলেন, “আমি আরও ব্যথিত যে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় টানা ১২ বছরের মতো। অথচ আমার ভাই, যিনি বীর যোদ্ধা হিসেবে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে পেয়েছিলেন সেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দারের নাম-নিশানা দেখিনি ঢাকায়। এমনকি জয়পুরহাট মহিলা ক্যাডেট কলেজে ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এটি এম হায়দারকে তিনি চেনেন কিনা কিংবা তার সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা। উত্তর দিতে পারেননি। একেবারে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এভাবেই দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গকারীরা অবহেলিত-উপেক্ষিত।”

সিতারা জানান, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর রেইসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণের দলিল সম্পাদনের সময়েও আমার ভাই সেখানে ছিলেন। ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তের ছবিতে তিনি রয়েছেন। তবু কেন তার যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না এটি আমাকে সবসময় ব্যথিত করে।

সিতারার আক্ষেপ, এভাবে হয়তো ত্যাগী মানুষেরা সবসময় উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছেন। যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। আমি এ টি এম হায়দার বীর উত্তমের যথাযথ সম্মান দেখতে চাই। বিজয় দিবসে এটি-ই আমার প্রত্যাশা।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!