এক যুগ আগে বন্দর নগরীর চকবাজার থানার জয়নগর এলাকায় এমন ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন দুই বোন মুমতাহা কারিনা ও সালসাবিল তাসনিম।
ঘটনার সময় কারিনার বয়স ছিল ১৯, ছোট বোন তাসনিমের বয়স ছিল ১৬ বছর। তাদের চিকিৎসায় শহরের সব স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে ফেলায় পরিবারটি এখন গ্রামে ফিরে যাচ্ছে।
তবে অ্যাসিড ছুড়েও বিয়ে আটকানো যায়নি। ঘটনার ছয় মাস পর ঠিক করা পাত্রের সঙ্গেই বিয়ে হয় কারিনার। পরে ছোট মেয়ে তাসনিমেরও বিয়ে হয়।
এ ঘটনায় বুধবার চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত আসামি ফারজানা লতিফ সাকি (৩৫) ও ছোট ভাই ইফতেখার লতিফ সাদিকে (৩৩) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
নগরীর বাদুরতলা এলাকার বাসিন্দা আবদুল লতিফের ৫ সন্তানের মধ্যে সাকি ও সাদি বড় দুই ভাইবোন।
রায় ঘোষণার সময় দুই বোন মুমতাহা কারিনা (৩১) ও সালসাবিল তাসনিম (২৮) আদালতে আসেননি। এসেছিলেন তাদের মা আনার কলি ও বাবা আনোয়ারুল কবির।
আনার কলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর বড় মেয়ে কারিনার বিয়ের দিন ঠিক হয়। ছেলে বিসিএস ক্যাডার, তখন চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা করতেন।
তিনি বলেন, “তাদের অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। আমাদের আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল। পারিবারিকভাবে সমাজে সবাই চিনত-জানত। আমার মেয়ে বয়সে সাকির চেয়ে ছোট।
“তার আগে এবং এত ভালো পরিবারে বিয়ে ঠিক হওয়ায় সাকি ঈর্ষান্বিত হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। আগে থেকেই তারা আমাদের পারিবারিক অবস্থা নিয়ে হিংসা করত।”
মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে স্বামী আনোয়ারুল কবিরসহ ২০১০ সালের ১ অক্টোবর কক্সবাজার জেলার চকরিয়ায় গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন আনার কলি। তার বোনের মেয়ে সাকি তখন বাসায় ছিলেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কারিনার মা বলেন, “আমার দুই মেয়ের সঙ্গে বেডরুমের মেঝেতে বিছানা করে ঘুমিয়েছিল সাকি। পরদিন ২ অক্টোবর সকালে আমার মেয়েদের মুখে এসিড ছুড়ে মেরে সাকি বাথরুমে চলে যায়।
“সেখানে নিজের মুখে একটু এসিড মাখে যাতে সবাই বিশ্বাস করে তাকেও এসিড মারা হয়েছে।”
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সাকির ছোট ভাই ইফতেখার লতিফ সাদি সম্পর্কে তিনি বলেন, “আগের দিন সাদি বোনের কথা মত এসিড এনে তাকে দিয়ে যায়।”
ঘটনার পরবর্তী সময়ের বর্ণনা করে কান্নায় ভেঙে পড়েন আনার কলি। তিনি বলেন, “আমার মেয়েদের মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। আমার যা ছিল সবই তাদের চিকিৎসার জন্য খরচ করে ফেলেছি।”
তিনি জানান, ২০১০ ও ২০১২ সালে দুই মেয়েকে নিয়ে দু’বার ব্যাংককে যান চিকিৎসা করাতে। খরচ যোগাতে শহরের চট্টেশ্বরী রোড ও টেক্সটাইল এলাকায় কিছু জমি ছিল, সেসব বিক্রি করা হয়েছে।
কারিনা ও তাসনিমের মা বলেন, “আগামী মাসে গ্রামে চলে যাব। শুরুতে অনেক দামি দামি ইনজেকশন দেওয়া হয়। পরে সেখানকার ডাক্তার আবার নিতে বলেছিলেন প্লাস্টিক সার্জারির জন্য। তা আর নেওয়া হয়নি।
“আমাদের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা আর পূরণ হবার নয়। আমার দুই মেয়েকে একসাথে এসিড মারায় ফাঁসি হওয়ার কথা। তারপরও যাবজ্জীবন সাজায় আমরা সন্তুষ্ট। এখন চাই এ সাজা যেন কার্যকর হয়।”
আনার কলি বলেন, “শুধু হিংসা আর ঈর্ষার কারণে এমন একটা কাজ করল। আজ সত্যের জয় হয়েছে। এই রায় একটা উদাহরণ। ভবিষ্যতে যেন কেউ এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।”
তিনি জানান, রায়ের খবর শুনে দুই মেয়ে মা-বাবাকে ফোন করে কথা বলেছেন। তারা রায়ে খুশি। কারিনা এখন দুই সন্তানের মা, ছোট মেয়ে তাসনিম একটা চাকরি করেন।
রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি তসলিম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ কেমন ঈর্ষা যে, একজন বোন তার খালাতো বোনদের এসিডে ঝলসে দেবে।
“এটা অত্যন্ত নিন্দনীয়। সেই অপরাধের সাজা আজ তারা ভাই-বোন পেল।”
তবে আসামিদের আইনজীবী শম্ভু প্রসাদ বিশ্বাস এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানান।
তিনি বলেন, “২২-২৩ বছরের একজন মেয়ে নিজের খালাতো বোনদের অ্যাসিড মারবে আবার পরে নিজের মুখে অ্যাসিড মাখবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
“যারা সাক্ষী দিয়েছেন তারা কেউ প্রত্যক্ষদর্শী নন। আশা করি উচ্চ আদালতে কাঙ্ক্ষিত বিচার পাব।”
কারিনা ও তাসনিমের বাবা আনোয়ারুল কবির বলেন, “আমাদের এক যুগের অপেক্ষার অবসান হল। আমার মেয়েদের এত বড় ক্ষতি যারা করেছে তারা আজ শাস্তি পেল, এটাই আমার শান্তি।”
আরও পড়ুন
দুই খালাতো বোনের মুখে অ্যাসিড, চট্টগ্রামে ভাইবোনের যাবজ্জীবন