ক্যাটাগরি

ইউক্রেইন যুদ্ধ: পশ্চিমাদের ঐক্য টিকবে কতদিন?

এমন একটি পরিস্থিতিতে ইউক্রেইনের প্রতি সমর্থন নিয়ে কি পশ্চিমাদের ঐক্যে ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে? – সে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে সামরিক অভিযান শুরু করে মস্কো। শুরুতে দ্রুত ও কম ক্ষয়ক্ষতিতে এই লড়াই জিতে নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও সফল হননি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শুরুতে দিন যতই গড়িয়েছে ক্রেমলিনের ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।

তবে যুদ্ধের প্রায় সোয়া তিন মাস পেরিয়ে কিছু সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছে রাশিয়া। বিশেষ করে ইউক্রেইনের পূর্বে দনবাস অঞ্চল এখন প্রায় পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং মারিউপোল বন্দরের পতনের পর ক্রিমিয়ার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগও স্থাপন করেছে তারা।

যুদ্ধের এই মোড় বদলে কপালে কি কিছুটা ভাঁজ দেখা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের? এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেইনকে সহায়তা করে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো পথ কী হতে পারে? রাশিয়াকেও কতটা শায়েস্তা করা সম্ভব? – এমন প্রশ্নে কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও মিত্র পশ্চিমা নেতারা একই সুরে কথা বলছেন?

বিবিসি জানাচ্ছে, এসব প্রশ্নের মীমাংসায় একদিকে রয়েছে যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড ও বাল্টিক সাগর পাড়ের দেশগুলো, যারা পুতিনের শোচনীয় হার দেখতে চাইছে।

গত সপ্তাহে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস বলেছেন, “আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে রাশিয়াকে ইউক্রেইন থেকে তাড়ানো হয়েছে এবং ইউক্রেনীয়রাই তাদের তাড়াবে। ইউক্রেইনের সীমানা নিয়ে কোনো ছাড় দেওয়া যেতে পারে না।”

তবে ইউক্রেইনের সঙ্কট থামাতে অন্যপক্ষে ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির নেতারা ভিন্ন একটি পথ নেওয়ার কথা বলছেন।

মে মাসের শুরুতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো রাশিয়া ও ইউক্রেইনের মধ্যে অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানান এবং পশ্চিমা নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান যাতে তারা ‘কাউকে নাস্তানাবুদ করার বা প্রতিশোধ নেওয়ার আগুনে পোড়ানোর’ লোভ ত্যাগ করেন।

তার পরের দিনই হোয়াইট হাউজে বক্তব্য দেওয়ার সময় ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি বলেছেন, ইউরোপের জনগণ একটি অস্ত্রবিরতি ঘোষণার সম্ভাবনা বিবেচনা করতে চায় এবং আবারও বিশ্বাসযোগ্য কিছু সমঝোতা শুরু করতে আগ্রহী।

ইউক্রেইনের বন্দরগুলো দিয়ে কৃষ্ণ সাগরপথে গম ও অন্যান্য শস্য রপ্তানি শুরুর সম্ভাবনা খতিতে দেখতে পুতিনের সঙ্গে ম্যাঁক্রো ও জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের ৮০ মিনিটের ফোনালাপের পর এ নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ক্ষোভ ঝেড়েছেন লাটভিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আরটিস পাবরিকস।

তিনি টুইট করেছেন, “মনে হচ্ছে কয়েকজন কথিত পশ্চিমা নেতা রয়েছেন, যাদের নিশ্চিতভাবেই আত্মমর্যাদাহানির দরকার পড়েছে, এবং তারা রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।”

ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

মিশ্র ইঙ্গিত

স্বভাবতই ক্রেমলিনের কাছে যদি কারও মতের দাম থাকে, তিনি হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

অথচ জো বাইডেন একেক সময় একেক রকম ইঙ্গিত দিচ্ছেন। মার্চে পুতিনকে তিনি ‘যুদ্ধাপরাধী’ আখ্যা দিলেন, এরপর ইঙ্গিত দিলেন মস্কোতে ক্ষমতার পালাবদল দরকার। কিন্তু এ সপ্তাহে তিনি ইউক্রেইনে এমন রকেট দিতে রাজি হননি, যা রাশিয়ায় আঘাত হানতে পারে।

সাবেক রুশ প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বাইডেনের ওই ঘোষণাকে সাধুবাদ জানান। কিন্তু এরপরই বুধবার যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় তারা কিইভকে আরও উন্নততর রকেট ব্যবস্থা দিতে যাচ্ছে; যে ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ক্রেমলিন বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র আগুনে ঘি ঢালছে’।

বিবিসি লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্টের ‘মুখ ফসকে’ কথা বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও, সাধারণ মার্কিন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির অবস্থান স্পষ্ট করে থাকেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এক্ষেত্রে অ্যান্টনি ব্লিংকেন।

বার্লিনে সম্প্রতি নেটোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ব্লিংকেন জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং যে কোনো সমঝোতার আলোচনায় ইউক্রেইনকে যতটা সম্ভব শক্তিশালী করতে মনোযোগী, যাতে তারা মস্কোর আগ্রাসন ঠেকাতে পারে এবং নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব পুরোপুরি রক্ষা করতে পারে।

বিবিসি বলছে, খুবই শক্তিশালী বার্তা, তবে কীভাবে আসলে ‘শক্তিশালী’ করার বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করা যায়? এবং ইউক্রেইনের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব ‘পুরোপুরি’ রক্ষা করা বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে?

সুতরাং এটা কি বলা যায় যে ইউক্রেইনের বিষয়ে পশ্চিমাদের ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে- সেই প্রশ্ন তুলেছে বিবিসি।

সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান রিফর্ম-এর পরিচালক ইয়ান বন্ড বলেন, “শুধু রাশিয়ার তেলের ওপর অবরোধ আরোপে যে টানাপোড়েন পার করতে হয়েছে, তা খেয়াল করুন।”

এ সপ্তাহে রুশ তেলের ওপর ইইউর আংশিক অবরোধ আরোপের প্রসঙ্গে এ কথা বলেন তিনি।

এছাড়া রাশিয়ার গ্যাস দ্রুত বন্ধ করার ইইউর উদ্যোগও এরইমধ্যে ভেস্তে গেছে। বাল্টিক দেশগুলো ও পোল্যান্ড এই বিষয়টি দ্রুত করতে চাইলেও, এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী কায়া কালাস এ সপ্তাহে স্বীকার করেছেন যে (রাশিয়ার) বিরুদ্ধে ‘পরবর্তী সব অবরোধ আরোপ আরও কঠিন হবে’।

অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার জানান, পরবর্তী অবরোধ প্যাকেজে গ্যাস কোনো ইস্যু হিসেবে থাকছে না।

আরও অস্ত্র দরকার

পশ্চিমা অনেক বেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু কিইভ বলছে, প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কম।

ইউক্রেইনে আরও উন্নততর রকেট ও গোলন্দাজ ব্যবস্থা সরবরাহের বিষয়ে এ সপ্তাহের আমেরিকান ও জার্মান প্রতিশ্রুতি ইউক্রেইনের সামরিক নেতাদের জরুরি চাহিদা পূরণের পথে কিছুটা অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

তবে অভিযোগ রয়েছে জার্মানরা আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করা নিয়ে এখন গড়িমসি করছে এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনও চাচ্ছেন যাতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রগুলোর ব্যবহার শুধু ইউক্রেইনের ভূখণ্ডের ভেতরেই সীমিত রাখা হয়।

এটা এক ধরনের বিস্ময় সৃষ্টি করেছে যে কেনো পশ্চিমা ইউক্রেইনের যুদ্ধে একটা সীমা টানার চেষ্টা করছে যখন রাশিয়া কোনো সীমা মানছে না।

ইয়ান বন্ড বলেন, “এক ধরনের ঝালাই করার বিষয় কাজ করছে। বিষয়টা এমন হচ্ছে যে, আমরা চাই ইউক্রেইন জিতুক কিন্তু তারা যেনো খুব বেশি জিততে না পারে।”

একটি খুবই প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট পুতিন এই আশায় যুদ্ধে নেমেছিলেন যে পশ্চিমাদের আরেকটি যুদ্ধে নামার খুব একটা আগ্রহ এখন নেই। আফগানিস্তানে নেটো দেশগুলোর বড় ধরনের মর্যাদা খোয়ানোর পর নতুন করে আরেকটি আন্তর্জাতিক সম্মানহানি থেকে তারা দূরে থাকতেই চাইবে।

বিবিসি জানায়, মস্কো থেকে পাওয়া সাম্প্রতিক কিছু প্রতিবেদন ধারণা দিচ্ছে ক্রেমলিন ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে, বিশেষ করে রণক্ষেত্রে আস্তে আস্তে সাফল্য আসতে থাকায় এবং তাদের বিশ্বাস যে ‘এক সময় না এক সময় ইউরোপ সাহায্য করতে ক্লান্তিবোধ করবে’ – মেদুজা ওয়েবসাইটে একটি রুশ সূত্রকে এভাবেই উদ্ধৃত করা হয়েছে।

বিবিসি লিখেছে, এ সপ্তাহে ব্রিটিশ সরকার সতর্ক করেছে যে রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিলে এই শীতে ৬০ লাখ ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন দেখা দিতে পারে, যেটা হয়ত ক্রেমলিনের মনে ধরেছে।

ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমিরি জেলেনস্কির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমিরি জেলেনস্কির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

পশ্চিমে নাগরিক অসন্তোষ কি ইউক্রেইনের পক্ষে সমর্থন কমিয়ে দিতে পারে?

ইউএস ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স – অ্যাভরিল হাইনেস গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সদস্যদের সামনে এই বিপদের আশঙ্কাটি তুলে ধরেন।

সেনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটির কাছে তিনি বলেন, “তিনি [পুতিন] সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুর্বলতা প্রকাশের অপেক্ষায় আছেন, যেহেতু খাদ্য স্বল্পতা, মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানির দামের পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে এগুচ্ছে।”

নিজের ওপর ক্ষতি বয়ে আনার জন্য সব ধরনের উদ্বেগ এবং অস্ত্র সরবরাহ ঘিরে দ্বিধা থাকার পরেও ইউক্রেইনের পক্ষে সমর্থন দিয়ে যাওয়া নিয়ে পশ্চিমাদের ঐক্য এখনও প্রায় অটুট; তবে এরপরেও যে ফাটল রয়েছে তা বাড়তে পারে।

ইয়ান বন্ড বলেন, “যদি কোনো এক পক্ষ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারে, তখন তা আরও বেশি সমস্যা সৃষ্টি করবে। রুশরা যদি ইউক্রেনীয়দের পূর্বাঞ্চলের প্রতিরক্ষা দেয়াল ভেঙে ফেলতে পারে এবং নিপার নদীর অভিমুখে এগুতে শুরু করে, সেক্ষেত্রে অস্ত্রবিরতি অর্জনে ইউক্রেইনীয়রা কতটুকু ভূমি ছাড়তে রাজি হবে, এই বিষয়টিকে সামনে আনার জন্য।”

আবার একই সময়ে যদি ইউক্রেনীয় বাহিনী রুশদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করতে পারে- সে রকম পরিস্থিতির বিষয়ে ইয়ান বন্ড বলেন, “সেক্ষেত্রে পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে হয়ত বলা হবে ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার অধীনে থাকা দনবাস এলাকা পুনরুদ্ধার করতে যেও না।”

বিবিসি বলছে, এই বিতর্কই এখনই খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে না, তবে যখন বর্ষীয়ান মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার ডাভোসে বলেছিলেন যে ইউক্রেইনের উচিৎ হবে কিছু ভূমি ছেড়ে দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি স্থাপন করা।

তাকে ইউক্রেইন ও ইউক্রেইনের বাইরে থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যা সামনের দিনগুলোতে একটি ক্ষোভ মেশানো বিতর্কেরই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।