রপ্তানি আয় ও বিদেশি অর্থায়নের উচ্চ ধারা বজায় থাকার হালনাগাদ তথ্য প্রকাশের দিনে বৃহস্পতিবার এপ্রিল শেষে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৭ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতির দুসংবাদ আসে। আর চলতি হিসাবে ঘাটতির রেকর্ড হয় আগের মাস মার্চেই।
এমন পরিস্থিতিতে এদিন বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন আরেকটি নীতিগত পদক্ষেপের কথা জানায়; এতদিন ধরে বেধে রাখা ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়। বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতেই বড় ধরনের এ পরিবর্তনের পথে হাঁটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করে ডলার বাঁচানোর চেষ্টা আরও আগেই শুরু হয়েছিল। রেমিটেন্স বাড়াতেও প্রণোদনা বাড়ানোসহ নানান ছাড় দেওয়া হয়। তবে সেগুলোর ফল এখনও আসতে শুরু করেনি।
ফাইল ছবি
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের অর্থনীতির বড় ধরনের এ চাপ সামাল দিতে এ দুই পদক্ষেপ কাজে আসবে আগামীতে।
রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের পর্যবেক্ষণ ডলার সংকট ও বাণিজ্য ঘাটতির এ ধারা ছয় মাসের মধ্যে অনেকটা ‘স্বাভাবিক’ হয়ে আসবে।
এমন প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রপ্তানি পণ্য বৈচিত্রকরণের উপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
আর আমদানি পণ্যের চাহিদা মেটাতে এবং ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগামী বাজেটে ভূমিকা রাখার তাগিদ এসেছে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের কাছ থেকে।
ঘাটতিতে রেকর্ড
চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬৮ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। এসময়ে রপ্তানি আয় এসেছে ৪১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাব ধরে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
এক মাস আগেও যা ছিল ২৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের। আর এক বছর আগে গত বছর এপ্রিল শেষে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলারের। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এ ঘাটতি গত অর্থবছরের আলোচিত সময়ের চেয়ে বেড়েছে ৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার বা ৫৩ শতাংশ।
এ সময়ে আমদানি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে পেট্রোলিয়াম এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য। মূলধনী যন্ত্রপাতি রয়েছে তৃতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে।
ফাইল ছবি
আর দেশের আমদানি ও রপ্তানির এ ঘাটতি পূরণে ভূমিকা রাখে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এ খাতেও ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি দেখা দিচ্ছে। মে শেষে ১৮৮ কোটি ডলার আসার মাধ্যমে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমলেও জুলাই থেকে অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে আগের বছরের চেয়ে রেমিটেন্স কম এসেছে ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
গত এপ্রিল শেষে ১০ মাসে রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার ৭৩০ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, যা আগের বছরের এই সময়ের তুলনায় ৩৩৫ কোটি ৮১ লাখ ডলার বা ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম।
রপ্তানি আয় এবং ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে থাকা রেমিটেন্স মিলে আমদানি খরচ পূরণ করতে না পারায় জুলাই থেকে এপ্রিলে চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এক মাস আগেও যা ছিল ১৪ দশামিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।
গত এপ্রিল শেষে এক বছরের ব্যবধানে চলতি হিসাবের এ ঘাটতি ৮ গুণের বেশি বেড়েছে।
দেশ চলতি হিসাবে এত ঘাটতিতে কখনই পড়েনি। গত ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ঘাটতিতে পরে এক সময়ে উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাব। ওই অর্থবছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৫৮ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৫৪৪ কোটি ডলার। আর ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের ৯৫৬ কোটি ডলারের ঘাটতিই ছিল সবচেয়ে বড়।
বাণিজ্য ও চলতি হিসাবের ঘাটতির প্রভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার। ডলারের বিপরীতে কয়েকদিন ধরে অনেকটা নিয়মিতই সস্তা হচ্ছে টাকা। ডলারের সংকট দেখা দেওয়ায় রেমিটেন্স বাড়াতে একের পর এক সিদ্ধান্ত বদল করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
লেনদেন ভারসাম্যে রেকর্ড ১৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি
মে মাসে রেমিটেন্সে ধাক্কা, কমেছে ১৩%
২০২০ সালের এপ্রিলে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা; চলতি বছেরর একই সময়ে তা বেড়ে ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা হয়েছে। আর খোলা বাজারে ডলার হাত বদল হচ্ছে ৯৮ টাকায়, সম্প্রতি যা ১০২ টাকাতেও উঠেছিল।
অপরদিকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি বাড়ায় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে বিদেশি অর্থায়নে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৯ শতাংশ।
এ সময়ে ৭৭০ কোটি ৮৫ লাখ ডলার অর্থ পাওয়া গেছে বলে বৃহস্পতিবার তথ্য প্রকাশ করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
বিদেশি অর্থায়নের এ উচ্চ গতিও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের বাজারে স্বস্তি আনতে পারেনি।
আমদানি চাপে কাজে আসছে না রপ্তানির উচ্চ প্রবৃদ্ধিও
ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকায় এক মাস বাকি থাকতেই পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যামাত্রা ছাপিয়েছে রপ্তানি; মে মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেড়েছে ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
ফাইল ছবি
গত ১১ মাসে ৩,৯৮৬ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪,৭১৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ আয় আগের বছরের জুলাই থেকে মে সময়ের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি।
অপরদিকে চলতি অর্থবছরের গত ১০ মাসে রপ্তানি আয় এসেছে ৪১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
অথচ বৈদেশিক বাণিজ্যের আরেক পিঠ আমদানিতে দেখা যায়, একই সময়ে সেবা ও পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬৮ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৪৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার।
দশ মাসে বিদেশি ঋণ এসেছে পৌনে ৮ বিলিয়ন, বেড়েছে ৫৯%
নতুন বাজেটে আমদানি কমানো, ব্যাংক ঋণ বাড়ানোর ছক
এ হিসাবে আলোচিত সময়ে আমদানি বেড়েছে ৪১ দশমিক ৪২ শতাংশ বা ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভ দিয়ে আমদানি ব্যয় মিটবে ৬ মাসের
ফাইল ছবি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। এ দিয়ে বর্তমান আমদানির ধারা অনুযায়ী দেশের ছয় মাসের ব্যয় মেটানো যাবে। মে মাসে আমদানি ব্যয় ছিল ৭ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকতে হয়।
কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা
বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কিন্তু ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটি অর্থনীতির জন্য ভালো। এতে কর্মসংস্থানে সহায়ক হচ্ছে।’
‘‘দীর্ঘদিন অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব ছিল। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ। এরফলে সরবরাহ চ্যানেল ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাই আমদানি পণ্যর খরচও বেড়েছে।’’
ফাইল ছবি
এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘সরকার আমদানিতে লাগাম টানতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ডলার আনতে রেমিটেন্স পাঠাতেও ছাড় দিয়েছে।
‘‘ডলার সংকট ও বাণিজ্য ঘাটতির এ ধারা আগামী ছয় মাসের মধ্যে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’’
অপরদিকে বিশাল এ বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রপ্তানি পণ্য বৈচিত্রকরণের উপর জোর দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনার সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘এখনও একটি পণ্য হিসেবে তৈরি পোশাক খাতের উপর ভর করে আমাদের রপ্তানি দাঁড়িয়ে আছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে পণ্য বৈচিত্রকরণের দিকে যেতে হবে।
‘‘যতদিন না এটি করা সম্ভব হচ্ছে ততদিন এই ঝুঁকি থাকবে। আর আমদানি পণ্যের মধ্যে মূলধনি যন্ত্রপাতির ব্যবহার সঠিকভাবে হচ্ছে কি না তা তদারকি করতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে।’’