তাদের আশঙ্কা, পদ্মা সেতু খুলে দিলে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি রুটে যানবহন
ও যাত্রীর চাপ কমে যাবে। ফলে পাটুরিয়া ঘাট এলাকার খাবার হোটেল থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ
দোকান ও ফেরিওয়ালার বিক্রিও কমবে। আর বেচা-বিক্রি কমে গেলে সংসারের টানাটানিও বেড়ে
যাবে।
মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান, সেখানে চা-বিস্কুট
ও টং দোকান রয়েছে দুই শতাধিক। এসব দোকান পাঁচ শতাধিক মানুষের আয়ের উৎস।
এ ছাড়া ঘাট এলাকায় ২০-৩০টি খাবার হোটেল রয়েছে। পেয়ারা, ডাব,আনারস, ডিম
ও ঝালমুড়ি বিক্রি করেন শতাধিক ভ্রাম্যমাণ ব্যক্তি। পদ্মা সেতু চালু হলে এই ফেরি রুটে
যাত্রী ও যানবহন কমে তাদের বেচা-বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলছেন তারা।
তবে মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, ঢাকার সাভার ও আশুলিয়ার যানবাহনগুলো পাটুরিয়া
ঘাট হয়েই যাবে বলে এলাকার লোকজন ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিসি সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি
রুটে যানবাহন ও যাত্রীর চলাচল কী রকম থাকবে তা এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
পদ্মা সেতু চালু হলে অল্প দিনের মধ্যেই তা বোঝা যাবে।
পাটুরিয়া ঘাটের মায়ের আঁচল স্টোরের মালিক মো. রাজেদ আলীর বাড়ি মানিকগঞ্জের
শিবালয় উপজেলার দাসকান্দি এলাকায়। ২০ বছর ধরে তিনি সেখানে
দোকান চালিয়ে সংসার চালান।
তিনি বলেন, “দোকান চালিয়েই সংসার চলে। ২৫ জুন থেকে
কেনাবেচা কমে যাবে বলে মনে হচ্ছে। ছেলের পড়াশোনা আর সংসার চালানো নিয়ে টানাটানিতে পড়তে
হবে।”
চপ-সিংগারা বিক্রেতা শাহিনুর রহমান ও ফল বিক্রেতা আরমান মিয়ার ভাষ্য,
১২ বছর ধরে ঘাটে ভ্রাম্যমাণ দোকান চালিয়ে যাচ্ছেন। যাত্রী কমে গেলে তাদের বেচাকেনা
কমে যাবে।
১৭ বছর ধরে ঘাট এলাকায় শরবত বিক্রি করছেন আলীমদ্দিন।
তিনি বলেন, “শুনছি ফেরি ও যাত্রী কমে যাবে। এ ব্যবসা চললে করব, না হলে অন্যকিছু করব,
তবে কী করব তা জানি না।”
চার বছর ধরে ভ্যানে ডাব বিক্রি করে আসা ৬০ বছর বয়সী সামাদ মিয়া বলেন,
“দিনে যা আয় হয়
তা দিয়া সংসার চালাই। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। কোনো ছেলে নেই। বিক্রি কমে গেলে এ বয়সে
আর কী করব!”
অনিশ্চয়তার কথা জানিয়ে পাটুরিয়া পুলিশ কন্ট্রোল রুমের পাশে চা দোকানি
সাইদুল মিয়া বলেন,“সারাদিন চা বিক্রি করে চার-পাঁচশ যা থাকে
ওই টাকা দিয়া সংসার চালাই। পদ্মা সেতু হলে সব দোকানদারের যা হবে আমারও তা-ই হবে।”
পাটুরিয়া ঘাটের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের পাশে শরিফ হোটেলের মালিক শরিফের
বাড়ি রাজবাড়ীতে। তার হোটেলে আটজন কাজ করেন। ঘাটে যাত্রী কমে গেলে তার ব্যবসা চালানো
কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানান তিনি।
৩ নম্বর ঘাট এলাকার চা ও কনফেকশনারির দোকানি হানিফ মিয়ার ভাষ্য, “১২ বছর ধরে চায়ের
দোকান চালাই। বিস্কুট-কেকসহ আরও কিছু বিক্রি করি। পদ্মা সেতু চালু হলে যা সবার হবে
আমারও তাই-ই হবে। ইনকাম কমে যাবে।
“ছেলে পলিটেকনিকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছে। অনেক কষ্টে এখন
দিন চলছে। পদ্মা সেতু চালু হলে কষ্ট আরও বাড়বে।”
৫০ বছর বয়সী হানিফ বলেন, “এক সময় আরিচায়
দোকান করতাম। যমুনা সেতু হল, বাস আসত না, দোকান করা কষ্ট হইয়া গেল।”
ঈগল পরিবহনের টিকিট চেকার গৌতম বলেন, ঈগলসহ অনেক পরিবহন পদ্মা সেতু হয়ে
২১ জেলায় যাতায়াত করবে। আর সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুরের লোকজন পাটুরিয়া ঘাট হয়েই যাবে।
পদ্মা সেতু চালু হলে পাটুরিয়ায় বাস ও যাত্রী কমবে।”
৩ নম্বর ঘাটে মোবাইল ফ্লেক্সিলোডের দোকানি আতিক বলেন, “সবার মুখে একই
আলোচনা – পদ্মা সেতু চালু
হলে পাটুরিয়া ঘাটে ক্ষুদ্র ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের কী হবে।”
আবুল খায়ের কনজ্যুমার আইটেমের ডিলার দিলিপ দাস অর্ধশতাধিক দোকানে পণ্য
সরবরাহ করে থাকেন।
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু চালু হলে দোকানি কমে গেলে আমার
ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ যাতায়াত করে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া
ও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট হয়ে। সারাবছরই ফেরি পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে নানা ঝক্কি-ঝামেলা
পোহাতে হয়। পদ্মা সেতু খুললে সেই ভোগান্তি থেকে রেহাই মিলবে।
তবে সেতু চালু হলে ফেরি কম চলবে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে
পারছে না বিআইডব্লিউটিসি সংশ্লিষ্টরা।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম এবং পাটুরিয়া ঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত
কর্মকর্তা শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন,যাত্রী ও যানবাহন
চলাচলের উপর তা নির্ভর করবে। আগেই কিছু বলা যাচ্ছে না।
“লাইট ট্রাক বিশেষ করে এক, দেড়, আড়াই, তিন টনের ছোট
পিকআপ পদ্মা সেতু হয়ে ২১ জেলায় যাতায়াত করবে বলে ধারণা করছি। তবে সেতু চালু হলেও পণ্যবাহীসহ
বড় ট্রাক আগের মতোই চলবে বলে মনে হচ্ছে।
“ফরিদপুর-রাজবাড়ীসহ কয়েকটি জেলায় বিশেষ করে গাবতলি থেকে
ছেড়ে আসা পরিবহনগুলো পাটুরিয়া ঘাট দিয়েই পারপার হবে।”
ফেরি কম চলবে কিনা সে বিষয়ে তিনি বলেন, “যাত্রী আর যানবাহন
চলাচলের উপর তা নির্ভর করবে। আগেই বলা যাচ্ছে না। ঘাটে ২১টি ফেরি রয়েছে। ঈদে আরও একটি
ফেরি ঘাটে যুক্ত হবে।”
খালেদ আরও বলেন, “ভ্রাম্যমাণ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও
হকাররা তাদের ব্যবসা নিয়ে যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তা মূলত সেতু চালুর এক-দুই সপ্তাহ
পরে বোঝা যাবে।”