নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কদমরসুল এলাকায় বিএম ডিপো নামের ওই কন্টেইনার টার্মিনালের সামনে রাত সাড়ে তিনটার দিকেও অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে লাগা আগুন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সব ইউনিট রাতে সাড়ে তিনটার দিকেও নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে অগ্নি নির্বাচক গাড়ি পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক রাজীব পালিত জানান, দগ্ধ ও আহতদের মধ্যে দুই জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। আর দুই জনকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়।
শনিবার রাত দেড়টার পরে তিনি চার জনের মৃতুর খবর দেন। এদের মধ্যে একজনের পরিচয় জানাতে পেরেছেন তিনি।
রাত চারটার দিকে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে আরও একজনের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়; তাতে মারা যাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচ জন।
র্যাব-৭ এর প্রধান মো. ইউসুফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছি ডিপোর ভিতর যারা আটকে পড়েছিল তাদের বের করতে। অনেক মানুষকে আমরা সবাই মিলে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল।”
রাত ১২টার পর থেকে হাসপাতালে একের পর এক গুরুতর আহতরা আসতে থাকেন।
চমেক হাসপাতালে থাকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক জানান, চমেক হাসপাতালে রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত আসা রোগীদের কোনো এন্ট্রি করা হয়নি। তবে দুইশর বেশি রোগী সেখানে এসেছেন। পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন বেরসকারি হাসপাতালেও রোগীদের নেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াস নগরীর চিকিৎসকদের আহতদের সেবায় রাতের বেলাতেই এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
রাত সাড়ে তিনটার সময়ও সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে আগুন জ্বলছিল।
সেখানে উপস্থিত একাধিক সংবাদকর্মী জানান, একের পর এক কন্টেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। টানা ছয় ঘণ্টা কাজ করার পরও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আশেপাশে পানির উৎসও কমে আসছে।
সবশেষ আগুন নেভাতে নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লাসহ সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলোকে সীতাকুণ্ডে আসতে বলা হয়েছে।
‘রাসায়নিকের বিস্ফোরণ থেকেই আগুন ছড়ায়’
শুরুতে ডিপোর কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এরপর স্থানীয় কুমিরা স্টেশনের দুটি ইউনিটের গাড়ি ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু পরে রাসায়নিকের একটি কন্টেইনারে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বলে ফায়ার সার্ভিস কর্মী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান।
স্থানীয়রা বলছেন, ডিপো থেকে তিন কিলোমিটার দূরের বাসিন্দারাও বিকট শব্দে বিস্ফোরণ শুনতে পান। আশেপাশের এলাকায় অনেক বাড়িঘরের কাঁচ ভেঙে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের আগ্রাবাদ স্টেশন থেকে সব গাড়ি রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়। এরপর রাত বাড়ার সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর সব স্টেশনের সব গাড়িই সেই ডিপোতে আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত হয়।
এরপর পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দাসহ স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন ওই ডিপোতে জড়ো হয়।
ফায়ার সার্ভিসের বিভাগীয় পরিচালক মো. আনিসুর রহমান উপস্থিত সাংবাদিকদের রাতে বলেন, আমরা যতটুকু লোকবল ও সরঞ্জাম আছে তার সব নিয়ে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু এখনো আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি।
“কিছুক্ষণ পর পর আগুন লাগছে কন্টেইনারে। সেখানে বিস্ফোরণও হচ্ছে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের নেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: সুমন বাবু
সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেমিকেলের কন্টেইনারে আগুন লাগার পর পানি দিলে তা আরও বেড়ে যায়। এতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এসময় আগুন নেভাতে গেলে সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের একজনের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।”
বিস্ফোরণের কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক শাহজাহান শিকদার।
রাত ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কুমিরা স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নুরুল আলম দুলাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছিলেন, ওই কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক থেকে আগুন লেগেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ আগুন লাগার কারণ সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি। ডিপোর এক কর্মকর্তা জানান, রাতের পালায় তাদের নিজস্ব দু’শর মত কর্মী ডিপোতে কাজ করেন। এরসঙ্গে আরও যুক্ত থাকেন কয়েকশ ট্রাক ও কভার্ডভ্যানের চালক, সহকারী ও শ্রমিকরা।
প্রায় ২৪ একর জমির উপর ওই ডিপোটি অবস্থিত। সেখানে কয়েক হাজার কন্টেইনার ছিল। তবে এ সংখ্যা আসলে কত তা নির্দিষ্ট করে কেউই জানাতে পারেনি।
শুরুতে আগুনের মাত্রা কম থাকলেও সময় যত গড়াতে থাকে ততই আগুনের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
আগুনে ডিপোতে থাকা কর্মচারী, ট্রাক চালক, শ্রমিক ও আগুন নেভাতে এগিয়ে আসা স্থানীয়রা আহত হন।
রাত সাড়ে ১১টা থেকে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পিকআপ ভ্যান ও হিউম্যান হলারে করে আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া শুরু হয়।
রাত বাড়ার সঙ্গে জেলা পুলিশ, র্যাব, ফায়ার সার্ভিসসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্তারা ছুটে যান বিএম ডিপো এলাকায়।
ডিপোতে যে রাসায়নিকের কন্টেইনার থেকে বিস্ফোরণ হয় সেটির আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে রাত ১টার দিকে। এসময় ডিপোর ভিতর থেকে বেশ কয়েকটি কাভার্ডভ্যান চালিয়ে বের হয়ে আসেন চালকরা। এসময় ভিতর থেকে আহত অনেককে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
বিজেএমইএ সহ সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে, “এখন পর্যন্ত আমাদের আটটি কাভার্ডভ্যানের চালক ও গাড়ির খোঁজ নেই। ওই ডিপোতে কন্টেইনার আছে কয়েক হাজার।
“বিশ্বের অন্যতম বড় ক্রেতা এইচএন্ডএমসহ বিভিন্ন বড় ক্রেতার পণ্য ওই ডিপোতে হ্যান্ডলিং করা হয়। কত কন্টেইনার আগুনে পুড়েছে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। কাল বলা যাবে। আগুন এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি।”
ঘটনাস্থল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে নগরীর চমেক হাসপাতলে নিয়ে যাওয়া আরেক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। প্রশাসনের নির্দেশনায় সীতাকুণ্ডের সব অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি চমেক এলাকায় থাকা সব অ্যাম্বুলেন্সকেও সীতাকুণ্ডে পাঠানো হয়।
এক পর্যায়ে সীতাকুণ্ড থেকে দ্রুত চমেক হাসপাতালে পৌছাতে ফৌজদারহাট থেকে বায়েজিদ পর্যন্ত বায়েজিদ লিংক রোডটি শুধু আহতদের বহনকারী যানবাহনের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
আহতদের বেশিরভাগ আসে চমেক হাসপাতালে
চমেক হাসপাতালে কয়েকশ আহত রোগীকে আনা হয়। সেখানে গিয়ে রাতে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াস চৌধুরী নগরীতে থাকা সব ডাক্তারদের চমেক হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সেবায় অংশ নিতে আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী রাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সব চিকিৎসককেও চমেকে গিয়ে সেবা কাজে যোগ দিতে নির্দেশ দেন।
রাত ৩টা পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক্তার ও নার্সদের হাসপাতালে ছুটে আসতে দেখা যায়।
সেবা কার্যক্রমে যোগ দেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, গাউসিয়া কমিটি, নগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা ও তাদের অনুসারীরা।
সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াস চৌধুরী জানান, আহতদেন মধ্যে বেশিরভাগই অগ্নিকান্ডের সময় ধোয়া গলা ও শ্বাসনালীতে গিয়ে আহত হয়েছেন। তাদের বাহ্যিক আঘাতের পরিমাণ কম। তবে দগ্ধ ও অন্যভাবে আহতরাও আছেন।
চমেক হাসপাতালের ছয়টি ওয়ার্ডে আঘাত অনুসারে আহতদের ভর্তি করানো হতে থাকে। রক্ত দিতে শত শত মানুষ ছুটে আসেন। তাদের সামলা দিতে হিমশিম খেতে হয় আনসার, পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের।
র্যাব-৭ এর প্রধান ইউসুফ বলেন, “রোগীদের দ্রুত সেবা দিতে আমরা হাসপাতালে শৃঙ্খলা রাখতে ব্যবস্থা করছি। সাধারণ মানুষ যেন অযথা ভিড় না করে মানুষকে সেবা নেয়ার সুযোগ দেয়।
হতাহতদের ‘দায়িত্ব নেবে’ বিএম ডিপো
কন্টেইনার ডিপোতে আগুনে দগ্ধ হতাহতদের চিকিৎসা ভার নেওয়ার ঘোষণা এসেছে ডিপো কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে।
শনিবার রাতে বিএম কন্টেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “কী কারণে আগুন লেগেছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কন্টেইনার থেকে আগুন লেগেছে বলে ধারণা করছি। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে হতাহতদের পাশে আমরা থাকব। “চিকিৎসার সব ব্যয় আমরা বহন করব। আহতদের সব রকম চিকিৎসা দেওয়া হবে।“
হতাহতদের ‘সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ’ দেওয়া হবে বলেও দাবি করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। এতে বরা হয়, “পাশাপাশি সব হতাহতদের পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া হবে। এছাড়া প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নিবে সেভাবে সব করা হবে।”
চট্টগ্রাম নগরী থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ২৪ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত বিএম কন্টেইনার ডিপোটির যাত্রা শুরু ২০১১ সালে।
ওই ডিপোর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের যৌথ বিনিয়োগে বেসরকারি এ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটি (আইসিডি) গড়ে তোলা হয়। এর চেয়ারম্যান নেদারল্যান্ডসের বার্ট প্রঙ্ক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশের মোস্তাফিজুর রহমান।
এ ডিপোতে পোশাক, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত খাতের পণ্যসহ বিভিন্ন ধরনের আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার জাহাজীকরণ ও পরিবহনের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
আরও পড়ুন: