‘সরকারের নির্দেশনায়’ প্রশাসনের
কর্মকর্তাদের পরামর্শে এই ঘটনা ঘটেছে। তাই গণমাধ্যমে এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় মানুষের
মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল
ট্রাস্ট্রের অনুমতি ছাড়া মুজিব বর্ষে অতি উৎসাহী হয়ে যেখানে সেখানে
জাতির পিতার ম্যুরাল না করতে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।
প্রায় দশ মাস আগে আওয়ামী
লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ঢাকার পাশের জেলা ও মহানগরের নেতাদের নিয়ে
বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার
কথা তুলে ধরে বলেছিলেন, “কর্মসূচি পালনের নামে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি না করতে নির্দেশনা
দিয়েছেন নেত্রী। মুজিব বর্ষে অতি উৎসাহী কিছু মানুষ, অতি
উৎসাহী কিছু কর্মকাণ্ডে যাতে লিপ্ত না হয়, সেব্যাপারে নজর দিতে হবে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমের অনুসন্ধানে জানা যায়, লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্টের (এলজিএসপি) আওতায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে
জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়ন পরিষদ প্রায় ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে সীমানা এই
ফলক নির্মাণ করে। ফলকটির একদিকে ‘স্বাগতম ভিতরবন্দ ইউনিয়ন’, অন্যদিকে ‘খোদা হাফেজ ভিতরবন্দ
ইউনিয়ন’, নিচে উভয়দিকে ‘বাল্য বিবাহকে না বলুন’ লেখা হয়। এছাড়া ফলকের উভয়দিকে শীর্ষে
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাইলসের উপর লাগানো হয়।
এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের কর্মকর্তা
ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের এক চিঠির নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধুর
এই ছবি ফলক থেকে অপসারণ করা হয়।
এই প্রকল্পের
সভাপতি এবং ৪,৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত ইউপি সদস্য আছমা বেগম সাফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমকে বলেন, “এটি ম্যুরাল
নয় টাইলসের উপর ছবি। চেয়ারম্যানসহ আমরা ভালোবেসে ও শ্রদ্ধা জানাতে জাতির পিতার প্রতিকৃতি
স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেই। এলজিএসপি প্রকল্পের অধীনে প্রায় ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে এ কাজ
করেছি। কোনো অনিয়মও হয়নি।”
ছবি অপসারণের পর
আছমা বলেন, এলজিএসপির কুড়িগ্রামের
ডিস্ট্রিক্ট ফেসিলিটেটর ফারুক আহমেদ সরকারি নির্দেশনা দেখিয়ে বলেছেন-‘বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি যেখানে সেখানে লাগানো যাবে না। এতে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা হবে।
আর এই প্রতিকৃতি না সরালে প্রকল্পের বিল ছাড় করা হবে না।’
“তাই আমরা বাধ্য হয়ে সরকারি
নির্দেশনা মানতে প্রতিকৃতি সরিয়ে নিয়েছি।”
ওই ভিতরবন্দ ইউনিয়নের সাবেক
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নাজিমুদ্দিন বলেন, “কতিপয় মিডিয়া
তার বক্তব্য বিকৃতভাবে প্রকাশ করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এখানে ম্যুরাল সরানোর
কোনো ঘটনা নেই। আমি কিছু জানতামও না। মোবাইলে সাংবাদিকদের তাই বলেছি। বলেছি খোঁজ-খবর
নেব। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি টাইলসের উপর সীমানা ফলকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
ছাপানো ছবি লাগানো হয়। পরবর্তীতে সরকারের নির্দেশনায় সরিয়ে ফেলা হয়।”
প্রায় এক বছর আগের এই ঘটনা
নিয়ে জনমনে ‘ক্ষোভ’ কিংবা ‘বিক্ষোভ’ নেই বলেও তার ভাষ্য।
ভিতরবন্দ ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা
কমান্ডের আরেক সাবেক কমান্ডার হাসান আলী বলেন, “ছবি
বা প্রতিকৃতি ম্যুরাল নয়। কাজেই এনিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই। আমার জানামতে প্রতিকৃতি
সরানো হয়েছে প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে। তবে একথা সত্য সীমানা ফলকে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি থাকলে ভালো লাগত।”
ভিতরবন্দ ইউনিয়ন
পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, “আমি ওই ফলকের উভয়দিকে জাতির পিতার প্রতিকৃতি স্থাপন করেছিলাম
শ্রদ্ধা থেকে এবং ভালবেসে। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিচিত
করতে। কিন্তু এলজিএসপি প্রকল্পের ডিস্ট্রিক্ট ফেসিলিটেটর ম্যুরাল না সরালে প্রকল্পের
বিল ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারে সিদ্ধান্ত জানান তিনি। তখন
আমি পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের মতামত নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সরিয়ে নিতে বাধ্য হই।
এর পরে প্রকল্পের বিল পাওয়া যায়।”
তিনি আরও বলেন, “এই ঘটনা
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটলেও হঠাৎ করে আমার প্রতিপক্ষ গ্রুপ মিথ্যা তথ্য
দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছেন। বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ
তৈরীর জন্য। আমি আশা করি প্রশাসন তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”
এলজিএসপির ডিস্ট্রিক্ট
ফেসিলিটেটর প্রতিকৃতি সরানোর বিষয়ে সঠিক জবাব দিতে পারবেন বলে তিনি জানান।
কুড়িগ্রাম জেলায় কর্মরত
এলজিএসপি প্রকল্পের ডিস্ট্রিক্ট ফেসিলিটেটর ফারুক আহমেদ বলেন, “যত্রতত্র জাতির পিতার
ছবি স্থাপন না করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সম্বলিত একটি চিঠি আমাদের প্রকল্প দপ্তর
থেকে পাঠানো হয়েছিল। এই বিষয়ে চলতি বছর ফ্রেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়
সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেই নির্দেশনা মোতাবেক আমি ভিতরবন্দ ইউনিয়নের সীমানা ফলক থেকে জাতির
পিতার ছবি (প্রতিকৃতি) সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। সে মোতাবেক কাজ হওয়ায় প্রকল্পের
বিল ছাড় করা হয়।”
কুড়িগ্রাম জেলা
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
প্রতিকৃতি আর ম্যুরাল নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো ঠিক নয়। কোনটি ম্যুরাল আর কোনটি ছবি বা
প্রতিকৃতি তা সবার জানা উচিৎ।”
নাগেশ্বরী উপজেলা
নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর আহমেদ মাছুম বলেন, “এই ঘটনা প্রায় এক বছর আগের। ম্যুরাল নয়,
এটি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, যা সরকারের নির্দেশনায় সরানো হয়েছে। কোনো আইনের ব্যত্যয়
ঘটেনি। প্রকল্পের স্বার্থে এটি করা হয়েছে। তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।”
নাগেশ্বরী উপজেলা
পরিষদ চেয়াম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান বলেন, কুড়িগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল
সরানোর কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে এক বছর আগে ভিতরবন্দ ইউনিয়নের সীমানা ফলকে বঙ্গবন্ধুর
প্রতিকৃতি স্থাপনের কয়েকদিনের মাথায় সরানো হয় সরকারি নির্দেশনায়।
তবে এতদিন পর এই ঘটনাকে
‘ভুল ব্যাখা’ দিয়ে যেন কেউ দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ নিতে না পারে সে ব্যাপারে
সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি।