ক্যাটাগরি

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন: যা যা জানা গেছে

লন্ডন ও আশপাশের এলাকায় করোনাভাইরাসের এই বদলে যাওয়া ধরনটি দ্রুত ছড়াচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইতোমধ্যে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন।

তিনি বলেছেন, “ভাইরাস যখন তার আক্রমণের পদ্ধতি বদলাচ্ছে, আমাদেরকেও আত্মরক্ষার কৌশল বদলাতে হবে।”

দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনাভাইরাসের এরকমই আরেকটি ধরন পাওয়া গেছে, যাতে মিউটেশন ঘটেছে কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের ধরনটির মতই।

দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যাবে এখন যেসব ভাইরাসের জেনেটিক অ্যানালাইসিস হচ্ছে, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ওই বদলে যাওয়া রূপটিই পাওয়া যাচ্ছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, বিজ্ঞানীরা নতুন করোনাভাইরাসের এই রূপবদল নিয়ে উদ্বিগ্ন, তবে বিস্মিত নন।

ভাইরাসের ক্ষেত্রে জিনগত পরিবর্তন বা মিউটেশন খুব সাধারণ ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জিনকাঠামোতে ওই পরিবর্তন খুব বড় কোনো পার্থক্য তৈরি করে না।

গতবছরের শেষ দিক থেকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও ছোটখাটো এরকম হাজারো মিউটেশন দেখতে পেয়েছেন গবেষকরা। 

রূপ বদলে ভাইরাস কখনও কখনও আগের চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, কখনও আবার সংক্রমণের ক্ষমতা কমে দুর্বল, এমনকি নিশ্চিহ্নও হয়ে যেতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই বলে আশ্বস্ত করেছে যে, যুক্তরাজ্যে পাওয়া নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে অনেক বেশি শঙ্কিত হওয়ার মত কিছু এখনও পাওয়া যায়নি।

উদ্বেগ কেন?

বিবিসি লিখেছে, যুক্তরাজ্যে পাওয়া নতুন ধরনটির ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় দেখা যাচ্ছে, যা গবেষকদের উদ্বিগ্ন করছে।

১. নতুন এই ধরনটি সেখানে দ্রুত অন্য ধরনগুলোর জায়গা নিচ্ছে।

২. মিউটেশনের ফলে এ ভাইরাসে যে পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

৩. পরীক্ষাগারে দেখা গেছে, ভাইরাসের নতুন এই ধরনটি মানব কোষকে আক্রমণ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সবগুলো বিষয় এক হওয়ায় করোনাভাইরাসের নতুন এই ধরনটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা বাড়ছে।

কতটা দ্রুত ছড়াচ্ছে

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের এই বদলে যাওয়া রূপটি প্রথম শনাক্ত হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে। নভেম্বরে দেখা গেল লন্ডনে যত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের এক চতুর্থাংশ ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের নতুন ওই ধরনটি দায়ী।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এসে সেই অনুপাত দাঁড়িয়েছে দুই তৃতীয়াংশে।

 

লন্ডন ইমপেরিয়াল কলেজের গবেষক ড. এরিক ভলজ বলছেন, “এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন, তবে এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি, এটা খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে, আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর চেয়েও এটা দ্রুত। এর ওপর নজর রাখা জরুরি।”

যুক্তরাজ্যের এই বদলে যাওয়া ধরনটি কতটা বেশি সংক্রামক, সেটা নিশ্চিত করে বলা এখনই সম্ভব না। তবে সেই হার ৭০ শতাংশের আশেপাশে হতে পারে বলে ধারণ দিয়েছেন এই ব্রিটিশ গবেষক। 

কতটা ছড়িয়েছে

বিবিসি লিখেছে, করোনাভাইরাসের এই নতুন ধরনটি হয় যুক্তরাজ্যেই কোনো রোগীর দেহ থেকে ছড়িয়েছে, অথবা যুক্তরাজ্যের বাইরে থেকে এসেছে, যেখানে ভাইরাসের মিউটেশন পর্যবেক্ষণের যথেষ্ট ভালো ব্যবস্থা নেই।

নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ছাড়া যুক্তরাজ্যের প্রায় পুরো এলাকায় ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনটি পৌঁছে গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি বিস্তার ঘটেছে লন্ডন এবং ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিমাংশে। 

নেক্সটস্ট্রেইন নামের একটি সংস্থা পুরো বিশ্ব থেকে ভাইরাসের নমুনা নিয়ে জেনেটিক কোড বিশ্লেষণের কাজটি করে। তারা বলছে, যুক্তরাজ্যের ওই নতুন ধরনটি ইতোমধ্যে ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডসেও গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

দক্ষিণ আফ্রিকায় যে নতুন ধরনটি পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টটির অনেক মিল থাকলেও দুটোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই বলেই মনে করছে নেক্সটস্ট্রেইন।

এমন পরিবর্তন আগে ঘটেছে?

হ্যাঁ, ঘটেছে।

গত বছরের শেষে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের যে ধরনটি ছড়িয়েছিল সেটি এবং এখনকার দিনে পুরো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ছড়ানো ধরনটি এক নয়। 

ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপে ডি৬১৪জি নামের নতুন একটি মিউট্যান্টের উদ্ভব হয় এবং পরে সেই ধরনটিই পুরো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে।

গত গ্রীষ্মে এ২২২ভি নামের আরেকটি ধরনের উদ্ভব হয়েছিল স্পেনে, যেটি পরে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

মিউটেশনে কী পরিবর্তন ঘটেছে?

বিবিসি জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে পাওয়া নতুন ধরনটি বিশ্লেষণের প্রাথমিক তথ্য ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, এই মিউটেশনে করোনাভাইরাসের জিন কাঠামোতে যেসব পরিবর্তন এসেছে, তার মধ্যে ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। 

এর মধ্যে স্পাইক প্রেটিনে সম্ভাব্য পরিবর্তনের একটি বিষয়ও রয়েছে। এই স্পাইক প্রেটিনের কারণেই মানব কোষকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা নতুন করোনাভাইরাসের বেশি।

স্পাইক প্রোটিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যাকে বলা হয় ‘রিসেপটর বাইনডিং ডোমেইন’, সেখানেও পরিবর্তন এসেছে এন৫০১ওয়াই নামের একটি মিউটেশনের কারণে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্পাইক প্রোটিনের ওই অংশটিই সংক্রমণের সময় প্রথমে কোষের উপরিতলের সংস্পর্শে আসে। সেখানে মিউটেশনের ফলে যদি এ ভাইরাসের মানব কোষে প্রবেশ করা সহজ হয়ে যায়, তাহলে তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।

আরেকটি মিউটেশনে ভাইরাসের এ ধরনটির এইচ৬৯/ভি৭০ প্রেটিন বাদ পড়েছে, তাতে স্পাইকের একটি অংশ লোপ পেয়েছে। 

কেমব্রিজের গবেষক অধ্যাপক রবি গুপ্ত বলছেন, ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই পরিবর্তনের ফলে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। 

“এ ভাইরাস দ্রুত বাড়ছে। এ কারণেই সরকার উদ্বিগ্ন, আমরা উদ্বিগ্ন, বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই উদ্বিগ্ন।”

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোষ। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোষ। ছবি: রয়টার্স

নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট কোথা থেকে এল?

গবেষকদের বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের যে নতুন ধরনটি এখন ছড়াচ্ছে, তাতে ‘অস্বাভাবিক রকমের বেশি’ মিউটেশন ঘটেছে।

এমন হতে পারে যে, কোনো একজন রোগীর শরীরে ভাইরাসটি নিজেকে এভাবে বদলে ফেলেছে, যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই নাজুক হয়ে পড়েছিল। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসকে হারাতে পারেনি, বরং তার শরীর হয়ে উঠেছিল ভাইরাসের মিউটেশনের সূতিকাগার।

পরিবর্তনে ভাইরাস আরও বেশি প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে?

সেরকম কোনো প্রমাণ এখনও গবেষকদের হাতে নেই। তবে এ বিষয়ে আরও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

তবে করোনাভাইরাসের নতুন এই ধরনটি যদি দ্রুত ছড়াতে থাকে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়বে।

ভ্যাকসিন কি নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর হবে?

আলোচনায় থাকা প্রধান তিনটি টিকাই শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে মূলত করোনাভাইরাসের ওই স্পাইকের বিরুদ্ধে। আর সে কারণেই প্রশ্নটা আসছে, কারণ বদলে যাওয়া ভাইরাসটির মিউটেশনে স্পাইক প্রোটিনেও পরিবর্তন এসেছে।

তবে গবেষকরা মোটামুটি নিশ্চিত, করোনাভাইরাসের যেসব টিকা কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, সেগুলো নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও কাজ করবে। অন্তত আপাতত যে করবে, সে বিষয়ে তাদের সংশয় নেই।

ভ্যাকসিন এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে তা ভাইরাসের বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলে। ফলে মিউটেশনে যদি স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন আসেও, তৈরি হওয়া ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা থাকার কথা। 

তবে ভাইরাসটি যদি নিজেকে আরও বদলে ফেলে, তাহলে তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন কেমব্রিজের অধ্যাপক রবি গুপ্ত।

তার ভাষায়, এ ভাইরাস ভ্যাকসিন এড়িয়ে যাওয়ার পথ করে নিতে পারে- সে সম্ভাবনাও আছে। ইতোমধ্যে ভাইরাসের মিউটেশনে সে প্রক্রিয়ারই ইংগিত দিচ্ছে।

কোনো ভাইরাস যখন নিজেকে এতটা বদলে ফেলে যে, টিকা আর তার বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে না, তখন বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘ভ্যাকসিন এসকেপ’। তখন টিকা নেওয়ার পরও মানুষ আক্রান্ত হয়।

সম্ভবত এটাই এখন করোনাভাইরাসের মিউটেশন নিয়ে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়।

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস যে নিজের সংক্রমণ ক্ষমতা অটুট রাখতে নিজেকে বদলে নিচ্ছে, নতুন ভ্যারিয়েন্টটি তারই একটি নমুনা।

বদলে গিয়ে আরও সংক্রামক হতে পারে করোনাভাইরাস: গবেষণা

 

করোনাভাইরাসের রূপ বদলের হার বাংলাদেশে ‘অনেক বেশি’

 

করোনাভাইরাস: এখনও যা জানার বাকি