মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার শিলা গুহ তাদেরই একজন। যাত্রাদলের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে বাগেরহাটের এই মেয়ে এক সময় এসে ঠাঁই নিয়েছেন শ্রীমঙ্গলে। এখানে জালালিয়া সড়কের একটি ভাড়া বাড়িতে এক মেয়ে ও নাতনিকে নিয়ে থাকেন।
শিলা যাত্রাদলের সঙ্গে মুক্তিযদ্ধের শুরুর দিকে ছিলেন কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামের অলিপুর বালিকা বিদ্যালয়ে থাকাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্যাতিতা হন শিলা সাহা। দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর যাত্রাদলের গাড়ি চালক যতীন গুহের সঙ্গে শিলার বিয়ে হয়। এরপর স্বামীর পদবী নিয়ে হন শিলা গুহ।
বর্তমানের অলিপুর গার্লস স্কুল; যুদ্ধের সময় এখানে শিলাকে তুলে এনে নির্যাতন করা হয়
পরে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের খবর জেনে শিলাকে ছেড়ে চলে যান তার স্বামী যতীন। বাগেরহাটের পেয়াজহাটির কচুর হাঠখোলায় বাবার বাড়িতেও ঠাঁই হয়নি। সেই থেকে শিলা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় থাকছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাদের একজন স্বামীর বাড়ি থাকলেও আরেকজন ফিরে এসেছেন এক মেয়েসহ।
১৯৭১ সালে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলতে গিয়ে শিলা গুহ জানান, তখন যাত্রাদল ‘মুন লাইট অপেরার’ নায়িকা ছিলেন শিলা। দলের সঙ্গে তখন রংপুরের কুড়িগ্রাম জেলার অলিপুরে যান। দলের সঙ্গে অলিপুর স্কুলের একটি কক্ষে থাকার ব্যবস্থা হয়। পাশেই নাট মন্দির। সেখানে যাত্রাপালা হওয়ার কথা ছিল। এই সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
তখন এদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা আওয়ামী লীগ নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিত। এছাড়া তরুণী ও কম বয়সী গৃহবধূদের খান সেনাদের হাতে তুলে দিত।
অলিপুরের রাজাকার শাহাব উদ্দিনসহ তার অন্য সহযোগীরা পাকিস্তানি সেনাদের নারী সরবরাহ করত বলে স্থানীয়রা জানান।
স্কুল ঘরের শেষ প্রান্তের এই কক্ষে শিলাকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছিল
শিলা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একদিন সন্ধ্যার একটু আগে রাজাকাররা একটি জিপে করে পাকসেনা নিয়ে হাজির হয় অলিপুর গার্লস স্কুলে। পুরুষরা তখন বাইরে ছিল। শিলা তখন স্কুলের বারান্দায় বসে ছিলেন। অস্ত্রের মুখে শিলা, সবিতা ও মিনু নামে যাত্রাদলের তিন তরুণীকে ধরে নিয়ে যায় স্থানীয় ডাক বাংলোয় সেনাবহিনীর ক্যাম্পে। এখানে আরও কয়েকজনের সঙ্গে শিলা নির্যাতনের শিকার হন। একাধিক সেনাসদস্যের ধর্ষণের শিকার হন তিনি।
দিনের পর দিন শিলা ও অন্য তরুণীদের অলিপুর স্কুলের কক্ষে আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে পাকিন্তানি সেনারা। কোনো কোনো অজ্ঞান হয়ে যেতেন তিনি। ওই অবস্থায় কখনও সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে, কখনও বা গরম চায়ের কাপে আঙুল ডুবিয়ে জ্ঞান ফেরাত সেনাসদস্যরা।
শিলা জানান, এভাবে কিছুদিন চলার পর একদিন জ্ঞান না ফিরলে তারা শিলাকে মৃত ভেবে পাশে একটি ধান ক্ষেতে ফেলে দেয়। পরদিন সকালে সেখান থেকে স্থানীয় আবুল হোসেন ও তার ভাই সাত্তার লাশ দেখতে গিয়ে দেখেন শিলার শ্বাস রয়েছে। তখন তারা শিলাকে তাদের বাড়ির পাশে একটি হিন্দু বাড়িতে রেখে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করেন। তাদের দেখাশোনার জন্য জানানো হয় তাদের দলের মিনু ও তার স্বামী সুবাসকে। এই খবর খান সেনাদের কাছে গেলে তারা শিলাকে ক্যাম্পে পাঠাতে বলে। কিন্তু আবুল হোসেন ও সাত্তার তাকে রাখার বিষয়টি অস্বীকার করেন এবং আবুল পরে মধু নামে এক লোককে দিয়ে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। এরপর মধু পরিবারের লোকজনসহ শিলাকে ভারত চলে যান।
শিলা জানান, ভারত দেশ স্বাধীনের পর দেশে ফিরে শিলা বাগেরহাটের পেয়াজহাটির কচুর হাঠখোলায় নিজের বাড়িতে আসেন। বাবা বিহারী লাল সাহা ইতিমধ্যেই মেয়েকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ পান দলের লোকজনের কাছে। অন্য ছেলে মেয়েদের কথা চিন্তা করে বাবা তাকে বাড়িতে জায়গা দেননি। তাই বাড়ি থেকে ফিরে আসেন।
শ্রীমঙ্গলের জালালিয়া রোডের ভাড়া বাড়িতে গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত শিলা
তখন কামাল খাঁ নামে এক যাত্রা শিল্পীর মাধ্যমে আবার তিনি বনশ্রী অপেরা নামের যাত্রা দলে যোগ দেন বলে জানান।
শিলা বলেন, কয়েক বছর পর যাত্রাদলের গাড়ি চালক যতীন গুহের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শিলা সাহা থেকে তার পদবী হয় শিলা গুহ। তাদের সংসারে দুটি মেয়ে হয়। কিন্তু ছয় বছর পর স্বামী যতীন গুহ শিলার নির্যাতনের বিষয় জানতে পারেন। এরপর স্বামী যতীন পিরোজপুরে মাকে দেখতে যাওয়ার কথা বলে গিয়ে আর ফিরে আসেননি।
স্বামীকে বিভিন্ন স্থানে খুঁজে না পেয়ে শেষে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এসে আশ্রয় নেন শিলা।
শিলা আরও জানান, ভারত থেকে ফিরে তিনি মিনারভা, নিউ মিনারভা, বনশ্রী, গীতাশ্রী, রংমহল, বঙ্গশ্রী, মুনলাইট, আর্জ অপেরা ও সাধনাসহ অনেক যাত্রা দলে কাজ করেছেন। আবার যাত্রার দুর্দিনে মানুষের বাসায় কাজ করে দুই মেয়েকে বড় করেন। কষ্ট করে বিয়েও দেন। বিয়ের পর বড় মেয়ে স্বামীর বাড়িতে সংসার করলেও ছোট মেয়ে এক সন্তান নিয়ে ফিরে আসেন তার কাছে।
শিলার বলা সেই সময়ের কথা শোনার পর কুড়িগ্রামের অলিপুরের একাত্তরের প্রত্যক্ষদর্শী কিছু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে এর সত্যতা পাওয়া যায়।
১১ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা অলিপুরের বাসিন্দা রবিউস সামাদ বলেন, তখন তিনি যুদ্ধে। অলিপুর বালিকা বিদ্যালয়ে যাত্রাদলের টিম আটকা পড়েছিল তা দেখেছেন। তবে যুদ্ধ থেকে এসে শুনেছেন শাহাব উদ্দিন ও খড়কু রাজাকারের মাধ্যমে যাত্রাদলের নায়িকাসহ অনান্য মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে হানাদার বাহিনী।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দেওয়া বীরাঙ্গনা পরিচয়পত্র
ওই অপরাধে যুদ্ধ চলাকালে তার কোম্পানি শাহাব উদ্দিন রাজাকারকে হত্যা করে বলেও তিনি জানান।
এ ব্যাপারে অলিপুর ডাক বাংলোর তৎকালীন চকিদার বনিক উল্লাহ বলেন, ডাক বাংলোয় রাজাকারদের মাধ্যমে অনেক মেয়ে এনে দিয়েছেন। শারীরিক নির্যাতন শেষে অনেক মেয়েকে মেরে মাটি চাপা দিয়েছে। কাউকে কাউকে ফেলে দিয়েছে অন্যত্র।
শিলা গুহকে আনা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিলা গুহকে তিনি চিনতেন না। তবে যাত্রা দলের মেয়েদেরও আনা হয়েছে। অনেককেই মেরে ফেলেছে পাক সেনারা।
ওই এলাকার বাসিন্দা ও যুদ্ধের প্রথম দিকে এলাকায় অবস্থান করা সাংবাদিক পরিমল মজুমদার মুকুলের সঙ্গে কথা হয়।
পরিমল মজুমদার বলেন, যুদ্ধের শুরুর দিকে প্রথমে কলেজে, পরে গার্লস স্কুলে আশ্রয় নেয় একটি যাত্রা দলের লোকজন। অনেকে পালিয়ে গেলেও বেশ কয়েকজন মেয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় সেখান থেকে যেতে পারেনি। যাত্রাদলের নায়িকাসহ তিনজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা কিছুক্ষণ পরেই প্রত্যক্ষদশীদের কাছ থেকে তিনি জেনেছেন।
পরিমল বলেন, তার ধারণা ছিল এদের সবাইকে মেরে ফেলেছে পাকবাহিনী। ওই যাত্রা দলের নায়িকা শিলা বেঁচে থাকার বিষয়টি ৪৯ বছর পর জানলেন।
শিলা হাতজোড় করে একটি আশ্রয় প্রার্থনা করছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে
তিনি জানান, ওই বালিকা বিদ্যালয়ে শিলা ও তার দলের যাত্রার পোশাকসহ অনান্য সামগ্রী স্বাধীনতার প্রায় ১০ বছর পরও সংরক্ষিত ছিল। পরে স্থানের অভাবে স্কুল কর্তপক্ষ অন্য একটি যাত্রা দলের কাছে তা বিক্রি করে দেন।
৪ নম্বর সেক্টরের কমলপুর ক্যাম্পের কাম্পানি কমান্ডার আবু হাসনাতের দেওয়া একটি প্রত্যায়ন পত্রের মাধ্যমে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের খোয়াই এলাকায় শিলা গুহের সাথে তার দেখা হয় এবং তার পাকবাহিনী ও দেশীয় রাজাকার কর্তৃক তার নির্যাতনের বিষয়টি অবগত হন।
শিলা এখন মানুষের কাছে হাত পেতে নিজের সংসার পরিচালনা করছেন। জীবনের এই শেষ বেলায় এসে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ও মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া একটি বাড়ি পাওয়ার আবেদন করেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে তিনি শিলা গুহের সন্ধান পেয়েছেন এবং তার জীবনের কষ্টের গল্প শুনেছেন। তিনি মুজিব শতবর্ষের মধ্যেই তাকে দুই শতাংশ জমিসহ একটি ঘর দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।