যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বন্যা বুধবার এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “কেউ আমাকে সাক্ষী দিতে বলেনি, বাংলাদেশের কেউ সরাসরি জানতে চায়নি বা আমাকে জানায়নি কী হয়েছিল সেদিন, কাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল, কাদের আমন্ত্রণে সেদিন আমরা মেলায় গিয়েছিলাম…”
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়। ঘটনার পরদিন শাহবাগ থানায় তার বাবা প্রয়াত অধ্যাপক অজয় রায়ের করা মামলার বিচার চলছে।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলার মধ্যে মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম সারোয়ার জাকির বলেছিলেন, ‘ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও’ নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা মামলায় সাক্ষ্য দিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছেন না।
সেদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, “তাকে যথাযথ পদ্ধতিতে দূতাবাসের মাধ্যমে আদালতের সমন পাঠানো হয়েছিল। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার সঙ্গে কথাও বলা হয়েছিল।
“কিন্তু তিনি বলেছেন, সাক্ষ্য দেওয়ার আমার শতভাগ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আসতে পারছি না।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বরাতে তার এই বক্তব্য উদ্ধৃত করে বন্যা ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “বিচারের প্রহসন করবেন ভালো কথা কিন্তু তাই বলে এ রকম স্রেফ মিথ্যা কথা বলবেন? কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাকে ফোন করলো? রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর আমার নামে এ রকম নির্লজ্জ মিথ্যা কথা বলার কি খুব দরকার ছিল?”
তিনি আরও বলেন, “আমার সাথে গত ছয় (প্রায়) বছরে এফবিআই ছাড়া কেউ যোগাযোগ করেনি। আগেও লিখেছি এ নিয়ে, এখন আবারো বলছি, বাংলাদেশ সরকার বা আমেরিকায় বাংলাদেশের এম্বাসি থেকে কেউ কখনো যোগাযোগ করেনি আমার সাথে।”
তার এই বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলায় প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করা আইনজীবী গোলাম সারোয়ার জাকির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। আমেরিকার ঠিকানায় সমন পাঠিয়েছি। তার পরিবারের লোকদের সঙ্গে বন্যার ব্যাপারে যোগাযোগ করে বলেছি, উনাকে সাক্ষ্য দিতে আসতে বলেন। তারা বলেছে, পরে জানাবে কিন্তু পরে আর জানায়নি।
“মামলার সর্বশেষ আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) তার সঙ্গে এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং উনাকে সাক্ষ্য দিতে আসতে বলেছেন। আমেরিকায় বসে সাক্ষ্য দিতে হবে বললে তো হবে না, এদেশে আসতে হবে। আমেরিকায় বসে বিচার পাবেন না। তারও উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার, সেটা তিনি করেননি।”
‘নিরাপত্তা ঝুঁকিতে’ সাক্ষ্য দিতে আসছেন না বন্যা: রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, “সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এ মামলাসহ প্রচুর স্পর্শকাতর মামলা রয়েছে, যেগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য আমরা দুপুরে খেতেও পারি না। অথচ আমাদের নামে বদনাম দেওয়া হয়।”
বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৫ সালে বইমেলা উপলক্ষে দেশে ফিরেছিলেন দুজন।
২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা পৌঁছানোর পর রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন তারা।
সন্ত্রাসীর চাপাতির আঘাতে নিহত হন অভিজিৎ, তার স্ত্রী বন্যাও গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তার হাতের একটি আঙুল কাটা পড়ে। পরে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান তিনি।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতের ওই হামলায় অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও আহত হয়েছিলেন।
অধ্যাপক অজয় রায়ের করা এই মামলায় ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ আদালতে ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযাগপত্র জমা দেন মামলার সে সময়ের তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম। মামলায় ৩৪ জনকে সাক্ষী করা হয়।
ওই বছরের ১১ এপ্রিল ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান ছয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আমলে নেয়। পরে গত বছরের ১ অগাস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন তিনি।
মামলার আসামিরা হলেন চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আকরাম হোসেন ওরফে আবির, মো. আরাফাত রহমান ও শফিউর রহমান ফারাবি।
আসামিদের মধ্যে প্রথম দুজন পলাতক আছেন।
মামলার বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও ফেইসবুক পোস্টে প্রশ্ন তুলেছেন অভিজিতের স্ত্রী; বিচারের আশা ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
বন্যা বলেন, “গত ছয় বছরে কম তো প্রহসন দেখলাম না। সেই ২০১৫ থেকে একে তাকে অ্যারেস্ট করে পরে বলেছে, নাহ এরা আসামি নয়। প্রাক্তন মেজর জিয়াসহ প্রধান দুই-তিনজন আসামি দিব্যি ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে, তাদের টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ এই প্রাক্তন মেজর নাকি সশরীরে আক্রমণের দেখভাল করেছিল।
“তারপর শরিফ নামে একজনকে ধরে জানানো হল সে নাকি আক্রমণের মাস্টারমাইন্ড ছিল, এবং যথারীতি তাকে ক্রসফায়ারে দিয়ে মেরে ফেলা হল। এখন একটা লোকদেখানো বিচার হবে চুনোপুঁটিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য তাতেও আবার এত মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে!”
তিনি বলেন, “বাবা (অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়) পাঁচ বছর বিচারের জন্য অপেক্ষা করে করে চলে গেছেন। কোনো বিচারের আশা করি না আমি, শুধু এই হাস্যকর মিথ্যার প্রতিবাদটুকু জানিয়ে গেলাম এখানে।”