সম্পদের ওই পরিমাণ দেখিয়েই পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্তির (ডিরেক্ট লিস্টিং) আবেদন করেছে বেস্ট হোল্ডিংস। ১০ টাকা দামের শেয়ারে ৫৫টা প্রিমিয়াম ধরে ৬৫ টাকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে পুঁজিবাজারে থেকে ২৮৩ কোটি টাকা তারা তুলেতে চেয়েছে।
বেসরকারি কোম্পানির সরাসরি তালিকাভুক্তির সুযোগ না থাকায় বেশ কিছু আইনি প্রশ্ন তুলে বেস্ট হোল্ডিংসকে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত করার কার্যক্রম ইতোমধ্যে আটকে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
আর পুনর্মূল্যায়নে বেস্ট হোল্ডিংসের সম্পদের পরিমাণ যে হারে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
তাদের মধ্যে একজন ‘যোগ্য কোম্পানিকে দিয়ে’ নতুন করে বেস্ট হোল্ডিংসের সম্পদের মূল্যায়ন করার এবং আগের মূল্যায়নে কোনো অসঙ্গতি পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে বেস্ট হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। কথা বলতে চেয়ে মোবাইল ফোনে টেক্সট মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
নিয়ম এড়িয়ে বেস্ট হোল্ডিংসের সরাসরি তালিকাভুক্তির চেষ্টা আটকে দিয়েছে বিএসইসি
বেস্ট হোল্ডিংসে সরকারি ব্যাংকের বিনিয়োগ কেন, জানতে চায় মন্ত্রণালয়
লো মেরিডিয়ান
যেভাবে বেড়েছে দাম
আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ৩০ জুন বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। আর ২০২০ সালের ৩০ জুন মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৭ হাজার ৭২০ কোটি টাকা।
বিভিন্ন দফায় পূনর্মূল্যায়নে চার বছরে এ কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ ৪ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা বা ১২৬ শতাংশ বেড়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক হিসাবরক্ষণ কোম্পানি গ্র্যান্ট থরটন-বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান নুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সময়ে সময়ে কোম্পানির রিভ্যালুয়েশন করতে হয়। তাতে অল্প সময়ে ১৯ থেকে ২০ হতে পারে। কিন্তু ১৯ থেকে ৯৯ হওয়া সম্ভব না। এখানে জমির দাম যেভাবে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, বিল্ডিংয়ের দাম যেভাবে দেখানো হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে এগুলো ঠিক নেই।”
বেস্ট হোল্ডিংস সম্পদের মূল্য পুনর্মূল্যায়ন করে ২০১৭ সালে ভালুকায় তাদের ২৩ দশমিক ৮৬ একর জমির দাম ৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫১ কোটি টাকা করেছে।
একই বছরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ১ দশমিক ৪৯ একর জমির দাম ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২ কোটি টাকা।
আর নিকুঞ্জের সম্পদের মূল্য পুনর্মূল্যায়ন করা হয় ২০১৯ সালে। সেখানেই রয়েছে লো মেরিডিয়ান হোটেল।
নিকুঞ্জের ওই শূন্য দশমিক ৯৫ একর জমি ও ভূমি উন্নয়ন ব্যয় ৫৩৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে সে সময় ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রতি কাঠার দাম দাঁড়ায় ২১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
ওই জমির ওপর লো মেরিডিয়ান হোটেলের যে স্থাপনা আছে, তার দাম ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, লো মেরিডিয়ান হোটেলের জমি ও স্থাপনা মিলিয়ে মোট দাম ১ হাজার ৮৬৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। পুনর্মূল্যায়নে ওই সম্পদের দাম বেড়েছে ১০১ শতাংশ।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মো. মুসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে জমির দাম তারা যেভাবে ধরেছে, বাংলাদেশের কোথাও এত টাকা দামের জমি নেই। খতিয়ে দেখা দরকার বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড পুনর্মূল্যায়নকারীদের সাথে আঁতাত করে এত টাকা বাড়িয়ে দেখিয়েছে কিনা।”
সম্পদ পুনর্মূল্যায়নের প্রতিফলন বেস্ট হোল্ডিংসের পরিশোধিত মূলধনেও দেখা গেছে। ২০১৯ সালের ৩০ জুন তাদের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৮৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ২০২০ সালের ৩০ জুন তা এক লাফে প্রায় ১০ গুণ বাড়িয়ে ৮৭১ কোটি টাকা করা হয়।
ডিএসইর একজন সাবেক পরিচালকও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যিনি প্রায় তিন দশক ধরে স্টক ব্রোকারেজসহ সম্পদ মূল্যায়ন নিয়ে কাজ করছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সম্পদ বাড়িয়ে দেখানো হয় পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর জন্য। এছাড়া বাজারে শেয়ারের দাম বাড়ানোর জন্যও এটা করা হয়।
“তবে পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে বেস্ট হোল্ডিংস যেভাবে সম্পদের দাম বাড়িয়েছে, তাকে ‘অস্বাভাবিক’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। যোগ্য নিরীক্ষক দিয়ে তাদের সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন করা উচিৎ।”
ডিএসইর সাবেক এই পরিচালক বলেন, “সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয় যখন দেখা যায় বেস্ট হোল্ডিংস এই পুনর্মূল্যায়ন করিয়েছে মাহফেল হক অ্যান্ড কোং এর মত চার্টার্ড একাউন্টেন্ট দিয়ে।”
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকা বহির্ভূত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষায় নিয়োজিত অডিট ফার্মের তালিকা থেকে ৩৬টি ফার্মকে ‘অযোগ্য’ বিবেচনা করে বাদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেস্ট হোল্ডিংসের নিরীক্ষা ও পুনর্মূল্যায়নের কাজ করে দেওয়া আর্টিজান চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ও মাহফেল হক অ্যান্ড কোং এর নামও রয়েছে বাদ পড়া ফার্মের তালিকায়।
বেস্ট হোল্ডিংয়ের বিষয়ে কথা বলতে লো মেরিডিয়ান হোটেলের সম্পদ পুনর্মূল্যায়নকারী অডিটর ফার্ম মাহফেল হক অ্যান্ড কোং-এর পার্টনার আব্দুস সাত্তার সরকারকে ফোন করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তার পরামর্শ অনুযায়ী তাদের অফিসের মেইলে মঙ্গলবার প্রশ্ন পাঠানো হলেও জবাব আসেনি।
যোগ্য নিরীক্ষকের তালিকা থেকে ৩৬ অডিট ফার্ম বাদ
বেস্ট হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন
সরাসরি তালিকাভুক্তির চেষ্টা
মেট্রো গ্রুপের একটি সহযোগী কোম্পানি হিসেবে ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করা বেস্ট হোল্ডিংসের ব্যবসা রয়েছে নির্মাণ, রিয়েল এস্টেট, কৃষিভিত্তিক শিল্প, হসপিটালিটি ও বিজ্ঞাপনী বাজারে।
বেস্ট হোল্ডিংসের কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, তাদের ৫২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশের মালিকানা রয়েছে ব্যক্তি এবং কিছু প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির হাতে। আর বাকি ৪৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক প্লেসমেন্ট শেয়ার হোল্ডাররা।
আবার তার মধ্যে ২৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ মালিকানা রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালীর হাতে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, বেসরকারি কোনো কোম্পানির পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ এখন নেই। কিন্তু সেই নিয়ম এড়িয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ২৮৩ কোটি টাকা তোলার জন্য সম্প্রতি আবেদন করে বেস্ট হোল্ডিংস।
এক্ষেত্রে তারা চার সরকারি ব্যাংকের শেয়ার থাকার বিষয়টি যুক্তি হিসেবে দেখায়। পাশাপাশি নির্মাণ খাতের কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে নিয়ম শিথিলের সুপারিশ করে তিন মাস আগে অর্থমন্ত্রীর স্বাক্ষরে পাঠানো একটি চিঠিকেও তারা যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করে।
তবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পর্ষদ সভায় ওই আবেদন নিয়ে আলোচনার আগেই পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কয়েকটি আইনি প্রশ্ন তুলে বেস্ট হোল্ডিংসের তালিকাভুক্তির সকল কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়।
বিতর্কের মধ্যে অর্থমন্ত্রীর স্বাক্ষরে পাঠানো সেই চিঠির কার্যকারিতাও স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয় মন্ত্রীর দপ্তর থেকে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি কোম্পানির প্রাপ্য সুবিধায় বেসরকারি বেস্ট হোল্ডিংসকে স্টক এক্সচেঞ্জে সরাসরি তালিকাভুক্ত করে ‘প্রভাবশালী একটি মহল’ বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছিল, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্রুত হস্তক্ষেপে থামানো গেছে।
আর দীর্ঘদিন ধরে ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবসায় থাকা একজন বলেছেন, “সরকারি ব্যাংকের কাছে উচ্চ মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে বেস্ট হোল্ডিংস যে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা নিয়েছে, সেটাকে হালাল করতেই তারা মূল্যায়ন বাড়িয়ে দেখিয়েছে বলে আমি মনে করি।”
বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, ফাইল ছবি
চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের কোম্পানি রেইস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট পুঁজিবাজারে বেস্ট হোল্ডিংসকে তালিকাভুক্ত করতে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে
বেস্ট হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ ২০০৭ সালের বাতিল নির্বাচনে নোয়াখালী-২ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তার মালিকানাধীন গুলশানের উদয় টাওয়ারেই ছিল তারেক রহমানের বন্ধু বিতর্কিত গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের চ্যানেল ওয়ানের কার্যালয়, যা পরে বন্ধ হয়ে যায়।
একাধিক ব্যবসায়ীর ভাষ্য অনুযায়ী, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তারেক ও মামুনের সঙ্গে আমিনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই আমিনই জরুরি অবস্থার সময় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এক কোটি টাকা চাঁদাবাজির মামলা করেছিলেন। পরে তিনিই আবার বলেছিলেন, তাকে ওই মামলা করতে ‘বাধ্য করা’ হয়েছিল।
আমিনের কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের কোম্পানি রেইস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট। বেস্ট হোল্ডিংসের প্রসপেক্টাসে সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডেরও নাম আছে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে। কিন্তু আইসিবি থেকে বলা হচ্ছে, তারা এ বিষয়ে ‘কিছুই জানে না’।
বাজার সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, নাফিজ সরাফাতের সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেইসের অধীনে থাকা মিউচুয়াল ফান্ডগুলো থেকে বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা।
পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাফিজ কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান। সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমেও বিনিয়োগ করেছেন এবং একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হয়েছেন।
বেস্ট হোল্ডিংস: বিতর্কের মুখে অর্থমন্ত্রীর সেই চিঠির কার্যকারিতা স্থগিত
বেস্ট হোল্ডিংস: ‘না জানিয়েই’ সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইস্যু ম্যানেজার
পাঁচতারা হোটেলের মূল্য কত?
লো মেরিডিয়ান হোটেলে ভাড়া দেওয়ার মত কক্ষ আছে মোটি ৩০৪টি। এর মধ্যে ডিলাক্স কক্ষ আছে ২০০টি যার প্রতিটির আকার ৩৮ থেকে ৪৫ বর্গমিটার, ক্লাব কক্ষ আছে ৫৮টি, প্রতিটির আকার ৪৭ থেকে ৫২ বর্গমিটার। ক্লাব প্রিমিয়ার কক্ষ আছে ২১টি, প্রতিটির আকার ৫৫ থেকে ৬৫ বর্গমিটার। এক্সিকিউটিভ কক্ষ আছে ২২টি, যার প্রতিটির আকার ৭০ থেকে ৮০ বর্গমিটার। এলএম কক্ষ আছে দুটি, যার আকার ১৮৫ বর্গমিটার। আর প্রেসিডেনশিয়াল সুইট আছে একটি, যার আকার ৪১৮ বর্গমিটার। ইভেন্ট স্পেস আছে ৫ হাজার বর্গমিটার।
সব মিলিয়ে ভাড়া দেওয়ার মত কক্ষের মোট আকার দাঁড়ায় ২০ হাজার বর্গমিটার। হোটেলের মোট মূল্য তারা দেখিয়েছে ৩ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে লো মেরিডিয়ান হোটেলের প্রতি বর্গমিটারের মূল্য হয় ১৯ লাখ টাকা।
কিন্তু স্ট্যাটিসটা ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, যেখানে হোটেল নির্মাণের খরচ সবচেয়ে বেশি, সেই লন্ডনে ৫ তারকা মানের একটি হোটেল করতে ২০১৮ সালে প্রতি বর্গ মিটারে খরচ হত বাংলাদেশি টাকায় ৫ লাখ টাকার কম।
বাংলাদেশের এই খরচ আরো কম বলে তিনি জানিয়েছেন একজন স্থপতি, যিনি বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন ও পাঁচতারা হোটেল নির্মাণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
কিছুদিন আগে একটি পাঁচতারা হোটেল নির্মাণের খরচ সম্পর্কে তিনি বলেন, “সেখানে জমির মূল্য বাদে প্রতি স্কয়ার মিটারে খরচ হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে এটা আরো ২০ হাজার টাকা বাড়তে পারে। কিন্তু কয়েক গুণ হয়ে যাওয়ার কারণ নেই।
“আন্তর্জাতিক থাম্বরুল হল পাঁচতারকা হোটেলের প্রতিটি কক্ষ (গড়ে ৩৮ স্কয়ার মিটার) তৈরিতে দেড় লাখ ডলার (১ কোটি ২০ লাখ টাকা) খরচ হয়।”
আর বাংলাদেশে লো মেরিডিয়ানের প্রতি কক্ষের দাম দাঁড়াচ্ছে গড়ে সাড়ে ১২ কোটি টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতি স্কয়ার মিটারে এত টাকা করে বাড়িয়ে ধরে তারা একটা গুরুতর অন্যায় করতে যাচ্ছিল। এটা আটকে দেওয়া গেছে এতে খুব ভালো হয়েছে। না হলে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা অনেক বেশি মুনাফা দেখে, সম্পদ মূল্য দেখে এই শেয়ার কিনে নিত এবং পরে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ত।
“তবে এ ধরনের ঘটনা আর যেন না হয়, সে জন্য এ ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বড় শাস্তি দিতে হবে। আর আইনের যে ফাঁক-ফোকর দিয়ে এই কোম্পানি সরাসরি তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছিল, সেগুলো বন্ধ করতে হবে।”
প্রশ্ন শেয়ারের দাম নিয়েও
সরাসরি তালিকাভুক্তির চেষ্টায় বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের শেয়ারের দামও ‘অনেক বেশি’ ধরা হয়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
২০২০ সালের ৩০ জুনের হিসেবে বেস্ট হোল্ডিংসের নিট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ২৪৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর পর কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১০ লাখ। তাতে প্রতি শেয়ারে নিট সম্পদ হয় ৭১ টাকা ৭২ পয়সা।
বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের কাগজপত্রে বলা হয়েছে, তারা তাদের শেয়ারের দাম নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। ওই পদ্ধতিতে শেয়ারের সর্বোচ্চ মূল্য হতে পারে শেয়ার প্রতি নিট সম্পদের ১৫০ শতাংশ। সেখানে তারা দাম নির্ধারণ করেছে ৬৫ টাকা।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মো. মুসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো শেয়ারের দাম শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্যের মাধ্যমে সাধারণত নির্ধারণ করা হয় না। একটি কোম্পানির মোট মূল্য নির্ভর করে ভবিষ্যতে সে কত টাকা আয় করবে তার ওপর। বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের শেয়ারের দাম বেশি না কম সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে এই ধরনের কোম্পানির আয়ের ক্ষমতার সাথে তুলনা করতে হবে।”
সম্প্রতি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে অন্য যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে, তার মধ্যে মীর আক্তারের প্রতিটি শেয়ারে তালিকাভুক্তির আগে মুনাফা ছিল ৬ টাকা ৩২ পয়সা। বিনিয়োগকারীরা মীর আক্তারের শেয়ার পেয়েছেন ৫৪ টাকায়।
ই-জেনারেশনের শেয়ার প্রতি মুনাফা ছিল ১ টাকা ৮২ পয়সা। বিনিয়োগকারীরা ই-জেনারেশনের শেয়ার পেয়েছেন ১০ টাকায়।
তালিকাভুক্তির আগে ইনডেক্স অ্যাগ্রোর শেয়ার প্রতি মুনাফা ছিল ৭ টাকা ৭ পয়সা। বিনিয়োগকারীরা ইনডেক্স অ্যাগ্রোর শেয়ার পেয়েছেন ৫০ টাকায়।
এনার্জিপ্যাকের শেয়ার প্রতি মুনাফা ছিল ৩ টাকা ২০ পয়সা। বিনিয়োগকারীরা কিনেছেন ৩১ টাকায়।
তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে লুব-রেফের শেয়ার প্রতি মুনাফা ছিল ২ টাকা ৮ পয়সা। বিনিয়োগকারীরা কিনেছেন ২৭ টাকায়।
আর তালিকাভুক্ত হতে চাওয়ার আগে বেস্ট হোল্ডিংসের শেয়ার প্রতি মুনাফা ছিল ১ টাকা ৭ পয়সা। বিনিয়োগকারীদের কাছে তারা শেয়ার বিক্রি করতে চেয়েছে ৬৫ টাকায়।
বেস্ট হোল্ডিংসের প্রতিযোগী ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট ২০২০ সালে শেয়ার প্রতি মুনাফা দেখিয়েছে ৯৫ পয়সা। বৃহস্পতিবার এ শেয়ার ৩৯ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। সে হিসেবে তাদের পিই হয় ৪২।
বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চেয়েছে ৬৫ টাকায়। সে হিসেবে তাদের পিই দাঁড়ায় ৭১।