আর দুই সপ্তাহ পর মিরপুরের
তন্বি আক্তার স্নিগ্ধার দ্বিতীয় সন্তানের পৃথিবীর আলোয় আসার কথা। কিন্তু নতুন অতিথি
আগমনের খুশির আমেজ উধাও তার ঘর থেকে।
সবকিছু বন্ধ থাকায়
এমনিতেই বন্দিদশা, তারপর আবার স্নিগ্ধা যে চিকিৎসকের অধীনে আছেন, তিনিও চেম্বার বন্ধ
করে দিয়েছেন দুই সপ্তাহের জন্য। তাছাড়া হাসপাতাল থেকেই যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তখন
কী হবে? সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে এমন নানা দুশ্চিন্তা গ্রাস করেছে তাকে।
স্নিগ্ধা এখন আছেন
মিরপুর-১ এ বাবা-মায়ের সাথে। স্বামী, ১৫ মাস বয়সী বড় সন্তান, আর বড় দুই ভাইও তাদের
সাথে আছে।
সামাজিক দূরত্ব মানতে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ স্বজনদের সঙ্গে, ঘরবন্দি জীবনে যোগাযোগের উপায় কেবল মোবাইল ফোন
সবশেষ গত শনিবার চিকিৎসক
দেখিয়েছেন জানিয়ে স্নিগ্ধা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ সময়টায় ডাক্তারকে
যে কোনো প্রয়োজনে খুব দরকার। অথচ উনি দুই সপ্তাহের জন্য চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন।
ফোনে যোগাযোগ করতে বলেছেন। কিন্তু যে সমস্যাগুলোর মধ্যে পড়ছি, সেগুলো ফোনে সমাধান
সম্ভব না। আল্ট্রাসনোগ্রাম করে বাচ্চার অবস্থা দেখা প্রয়োজন, কিন্তু তা পারছি না। শেষ
সময়ে এসে খুব ভয়ে আছি।
“কোন হাসপাতালটায় ডেলিভারি
করাব, সেটাই ঠিক করতে পারছি না। যেখানে ভর্তি হব, সেখানে তো অন্তত দুই-তিন দিন থাকতে
হবে। আর দুই-তিন সপ্তাহ পর দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তাও জানি না। হাসপাতাল থেকেই
আমার আর বাচ্চার মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। সেখানে তো নানা ধরনের রোগী
থাকে। আমার ১৫ মাসের ছোট বাচ্চা, মা-বাবা, স্বামী আরও অনেকেই তখন হাসপাতালে যাবে আমার
জন্য। তারাও তো আক্রান্ত হতে পারে। চিন্তায় খাওয়া-দাওয়া, ঘুম বন্ধ হয়ে গেছে।”
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ
এই দেশে অতি সংক্রামক এই ব্যাধি বাংলাদেশে ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়লে কী পরিণতি ঘটবে-
তা নিয়ে সবার মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ-আতঙ্ক।
ঘরবন্দি জীবনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিয়া রহমান মন দিয়েছে আঁকিবুকিতে
জনসমাগমে ভাইরাস ছড়ানোর
ঝুঁকি বাড়ে বলে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা
এসেছিল আগেই।
আক্রান্তের সংখ্যা
ত্রিশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর গত সোমবার সরকার ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সব অফিস-আদালতে
ছুটি ঘোষণা করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্যও প্রায় বন্ধ।
কোভিড-১৯ এর বিস্তার
ঠেকাতে কার্যত অবরুদ্ধ রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের জীবন-যাপন বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন
এসেছে প্রাত্যহিক কাজেও।
অনেকেই ঘরে বসে কাজ
করার পদ্ধতিতে খুশিও হতে পারছেন না। নিত্যপণ্যের বাজারের জন্য অনেকে ঝুঁকেছেন অনলাইন
শপের দিকে।
বারিধারার বাসিন্দা
নীতা চট্টোপাধ্যায় কাজ করেন একটি বিদেশি সংস্থায়। এমন পরিস্থিতিতে গৃহকর্মীকে ছুটি
দেওয়ায় ঘরের কাজে তাকে অনেকটা সময় দিতে হচ্ছে।
গৃহকর্মীকে ছুটি দিয়ে বিক্রমের মত অনেকেই ঘরের সব কাজ সারছেন নিজে
“আগে টুকটাক ঘরের কাজ
করতাম। এখনও পুরোদমে করতে হচ্ছে। প্রতিদিনকার জীবনে একটা পরিবর্তন এসেছে। আগে হয়তো
টুকটাক রান্না করতাম। এখন পুরোটাই করছি। সকালে কাজ শুরুর আগে বাবা-মায়ের জন্য খাবার
তৈরি করতে হচ্ছে। সে হিসেবে পরিবর্তন তো এসেছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থী সামিয়া রহমান থাকেন মিরপুরে। মা, বাবা আর ভাই রয়েছে পরিবারে।
আটদিন ধরে তিনি বাসার
বাইরে বের হন না। ঘরের কাজে মাকে সহযোগিতা, পড়া, ছবি আঁকা, পেপার ক্রাফট আর শখের রান্নাবান্না
করে সময় পার করছেন তিনি।
সামিয়া বলেন, “১৮ তারিখে
শেষবার বের হয়েছিলাম, তারপর আর বের হইনি। বারান্দা
দিয়ে বাইরে দেখছি, অনেকেই আছে এখনও অহেতুক বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই সময়টা তো
বাসায় থাকার, এটা সবাইকে বুঝতে হবে।”
সামিয়া ভিডিও কলে ছাত্রীকেও
পড়াচ্ছেন ঘরে বসেই।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি
কর্মকর্তা এ এম এন জামান স্ত্রীসহ থাকেন মেয়ের সঙ্গে। মেয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা। জামাই
সাংবাদিক। দুজনেরই ব্যস্ত সময় সূচি বলে নিজেই বাসার বাজার করতেন। বর্তমানে সেটি করছেন
না।
করোনাভাইরাসের দীর্ঘ ছুটিতে সব গণপরিবহন বন্ধ; মহাখালীর একটি রিকশার গ্যারেজের ভেতরে নিরাপত্তকর্মীর কাটছে অলস সময়।
তিনি বলেন, “আগে বাজারের
জন্য বাইরে যেতাম। এখন মেয়ে যেতে দিচ্ছে না। যাওয়াটা উচিতও নয়। এজন্য ঘরেই থাকতে হচ্ছে।”
পল্লবীর বাসিন্দা কামারজাবিন
মিথি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছয় বছরের ছেলে স্কুলে যেত, বিকালে খেলতে যেত।
এখন দুটোই বন্ধ। কদিন ধরেই লক্ষ্য করছি ছেলে একটু খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। বাইরে
খেলতে যেতে না পারায় সারাদিন মোবাইল ফোন নিয়ে থাকছে।”
মিথি আরও বলেন, “এখন
পর্যন্ত বাজার থেকে কোনো কিছু পাইনি এমন হয়নি। তবে অন্য সময়ের চেয়ে দাম একটু বেশি।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থী মিম থাকেন পুরান ঢাকার বনগ্রামে। তিনি একটি পরিবারের সাথে সাবলেটে থাকেন।
এখন সময় কাটছে বাসার কাজ, রান্নাবান্না, সিনেমা দেখে আর বই পড়ে। ঘরে থাকলেও প্রতিবেশিদের
অসচেতনায় আশংকায় রয়েছেন তিনি। দুইদিন পর কিছু কেনাকাটা করতে বৃহস্পতিবার বাইরে বেরিয়েছিলেন।
মিম বলেন, “পুরান ঢাকার
মানুষের মাঝে তেমন সচেতনতা দেখিনি। পুলিশের ভয়ে মেইন রোডে তেমন লোক না থাকলেও অলিগলিতে
মানুষ ঘুরছে, এক ফ্ল্যাট থেকে আরেক ফ্ল্যাটে যাচ্ছে। আমার পাশের রুমে থাকেন একজন মুদি
দোকানী। তিনি বাইরে যাওয়া-আসা করেন। আমি ঘরে বন্দী থাকলেও উনি যেহেতু বাইরে যান, তাই
ওনার মাধ্যমে করোনায় আক্রান্ত হতে পারি। যতটুকু সম্ভব নিজেকে রুমের মধ্যে আবদ্ধ রাখছি।”
সবাইকে থাকতে হবে বাসায়, মুক্ত আকাশ মিলছে শুধু ছাদে। কেউ কেউ সময় দিচ্ছেন গাছের পরিচর্যায়।
তবে কতদিন এভাবে চলতে
পারবেন, তা নিয়ে চিন্তিত মিম।
“বাজার শেষ হয়ে গেলে
আবার আমাকে বের হতে হবে, ঘরে থাকার তো সুযোগ নেই। টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে খুব সমস্যায়
পড়ছি। টাকা তোলার জন্য বিকাশের দোকানগুলো খোলা পাচ্ছি না।”
শেখেরটেকের বাসায় স্ত্রী,
বোন আর ভগ্নিপতিকে নিয়ে থাকেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা সারওয়ার হোসেন কনক।
তিনি বলেন, “তিনজন
এখন বাসায়ই থাকছি। তবে খুব আতংকের মধ্যে দিন কাটছে। শারীরিক কোনো সমস্যা দেখলেই দুশ্চিন্তায়
পড়ে যাই। তবে বাসায় থাকা কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে, জনসমাগম এড়ানো যায়। এটা একটা
ভাল উদ্যোগ।”
কিন্তু ভগ্নিপতি গণমাধ্যমে
কাজ করায় যেহেতু তাকে বাইরে যেতে হয় সে কারণে তারা আরও বেশি উদ্বিগ্ন।
ব্যাংকের আইটি বিভাগে
কাজ করেন কনক। সে কারণে বাসায় বসে তাকে কাজ করতে হচ্ছে না। তবে যেকোনো প্রয়োজনে তার
ডাক পড়তে পারে, তখন বাধ্য হয়েই তাকে বাইরে বেরোতে হবে।
করোনাভাইরাসের কালে ঘরবন্দি জীবন
সারাদিন তিনি টিভির
খবর দেখেই সময় কাটাচ্ছেন, দেশ-বিদেশের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। নিজের কাজগুলো
করছেন। গৃহকর্মীকে ছুটি দিয়েছেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সাথে যেন দেখা না হয়, সেজন্য বাসার
বাইরে ময়লা রেখে দেন। দুই সপ্তাহের মত বাজার করে রেখেছেন তিনি।
অন্য একটি বেসরকারি
সংস্থায় আইটি বিভাগের কর্মরত আজিজুল হাসান বলেন, “আসলে বাসায় কাজ করার পরিবেশ নেই।
অফিসে যে পরিবেশ বাসায় সেটা থাকে না। অল্প একটু কাজ করলেই মনে হচ্ছে অনেক কাজ করে ফেলেছি।
কিন্তু কিছু করার নেই। জানি না কতদিন এভাবে কাজ করতে হবে।
“এখন পর্যন্ত বাজারের
জন্য দুটি অনলাইন শপের ওপর নির্ভর করছি। ডেলিভারি পেতে একটু সময় লাগছে। তবে মোটামুটি
প্রয়োজন মিটছে।”
বাইরে বেরুনো মানা, মহাখালীর এক ভবনের ছাদে উঠেছে ফুটবল
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও
শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) কর্মরত একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হালকা জ্বর এবং
কাশিতে আক্রান্ত হয়ে অফিসের সিদ্ধান্তে গত ১৫ মার্চ থেকে ঘরে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমকে বলেন, “এখন অবসরের এই সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছি রান্নাবান্না করে, সিনেমা দেখে
আর বইমেলা থেকে কেনা নতুন কিছু বই পড়ে।
“খাবার দাবার এবং ওষুধসহ
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মোটামুটি আগে থেকেই সংগ্রহে রেখেছি। তবুও জরুরি প্রয়োজনে
যেসব জিনিস দরকার হচ্ছে সেগুলো অনলাইনে কয়েকদিন আগে অর্ডার করেছি।”
তবে দেশের সামগ্রিক
অবস্থা বিবেচনা করে সবাইকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত সাবধানতা এবং সচেতনতা
অবলম্বন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।