ক্যাটাগরি

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ৫

আজ থেকে ৩৪ দিন আগে যখন আমরা জানতে পারলাম ইতালিতে ভাইরাস আউটব্রেকের কথা, দেশে চলে যাবার সব রাস্তা আমাদের সামনে খোলা থাকার পরও যাইনি। যেহেতু ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করাই যাচ্ছে, এখানে বসে কাজ করা আর দেশে বসে কাজ করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাছাড়া এখানে আমরা একটা সিস্টেমের মধ্যে আছি। সরকার যেভাবে নির্দেশ দিচ্ছে আমরা তা পালনও করছি।

প্রথম সপ্তাহে অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছিলো যেন আমরা ঢাকায় চলে আসি। যাইনি। যাবার কথা চিন্তাও করতে পারিনি। মনে হচ্ছিলো আমি এখানে বাসায় আছি এক অর্থে ভালো আছি। আমিতো এয়ারপোর্টেও সংক্রমিত হতে পারি, ট্রানজিটের সময়টাতেও সংক্রমিত হতে পারি। আর যদি আমার কারণে আমার বাবা-মাকে আমি অসুস্থ করে ফেলি, নিজের দেশের মানুষকে বড় বিপদে ফেলি, নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না।

করোনাভাইরাস সংক্রমের আশঙ্কার মধ্যে এ দুর্গতিকে হাতিয়ার বানিয়ে নিজেকে শান্ত রাখতে আমি এ ডায়েরি লেখা শুরু করেছিলাম। কিন্তু আজ আমি অশান্ত। আমি চিন্তিত আমার পরিবারকে নিয়ে, আমার দেশকে নিয়ে। ‘র‍্যাপিড গ্লোবাল প্যান্ডেমিক’ বলতে বুঝি অল্প সময়ের মধ্যে কোনো একটা রোগ বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া। ‘স্লোয়ার প্যান্ডেমিক’ মানে বেশি সময় ধরে সংক্রমিত হওয়া, ফলে একইসঙ্গে বেশি মাত্রায় সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা কম থাকা। এতে করে যে সুবিধাটা আমরা পাই তা হলো হাসপাতালে একই সময়ে অনেক রোগীকে ভর্তি হতে হয় না। অতএব সেবাপ্রদানকারী ডাক্তার, নার্স বা হেলথ প্রফেশনালরা ক্যাপাসিটির মধ্যে থাকে। ভাইরাস দ্রুত ছড়ানো বা ধীরে ধীরে ছড়ানো সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আমাদের উপর। আমরা যদি সবাই সোশাল ডিস্টেন্স বজায় রাখি তাহলে ভাইরাস ধীরে ধীরে ছড়াবে।

১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু আউটব্রেকের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুটা শহরের ঘটনা বলি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় ফ্লু ওয়ার্নিং অমান্য করে প্রায় ২ লাখ মানুষ ‘লিবার্টি লোন প্যারেড’ এ অংশগ্রহণ করেছিলো। তার ঠিক ৩ দিনের মাথায় সেই শহরের প্রত্যেকটা হাসপাতালে হাজার হাজার রোগী ভর্তি হতে শুরু করে। এক সপ্তাহের মধ্যে ৪ হাজার ৫০০ লোক মারা যায়। ঠিক একই সময়ে সেন্ট লুইস নামের আরেকটা শহর; ফ্লুতে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হবার পর স্কুল, কলেজ, চার্চ, খেলার মাঠে সব ধরনের জনসমাগম বন্ধ করে দেয়। আর একইসঙ্গে ২০ জনের বেশি লোক জমায়েত না হবার আদেশ দেয়।

এতে করে ৩ মাসে দুই শহরের মধ্যে মৃত্যুর হার তুলনা করে দেখা যায়, সেন্ট লুইসের চাইতে ফিলাডেলফিয়ার মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। এই ঘটনা দুইটা সোশাল ডিসটেন্সিং, লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনের গুরুত্ব প্রমাণ করে দেয়। ঠিক কতজন অসুস্থ হয়েছে বা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তার জন্য অপেক্ষা না করে যত তাড়াতাড়ি একটা দেশকে লকডাউন করা যাবে তত তাড়াতাড়ি এ ধরনের মহামারি ঠেকানো যাবে।

চীনের কথাই ধরা যাক। চীনের উহানে করোনাভাইরাস আউটব্রেকের একদিনের মাথায় অন্য কোনো চিন্তা না করে উহানকে লকডাউন করে দেওয়া হয়। তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুরের ভৌগোলিক অবস্থান মেইনল্যান্ড চীনের খুব কাছাকাছি। এমনকি এ তিনটি দেশের সঙ্গে উহানের সরাসরি ফ্লাইটও রয়েছে। চীনা নববর্ষের ঠিক দুইদিন আগে ভাইরাস আউটব্রেকের খবর পাওয়া মাত্রই এসব দেশ যে কয়টি পদক্ষেপ নেয় তা হলো:

১. কি ধরণের পদক্ষেপ নিতে হবে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া, যেমন মেইনল্যান্ড চীন, উহানের সঙ্গে যাতায়াত রেস্ট্রিকটেড করে দেওয়া, স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া, এমন পরিস্থিতিতে কর্মক্ষেত্রের পলিসি কেমন হবে, গণযোগাযোগ কেমন হবে তার পলিসি সবার মাঝে জানিয়ে দেওয়া।

২.কম সময়ের মধ্যে বেশি সংখ্যক মানুষের রোগের শনাক্তকরণ

৩. জনসমাগম এড়িয়ে চলা এবং সোশাল ডিস্টেন্সিং বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যোগাযোগ করা। তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর কিংবা হংকং এর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার তুলনামূলক খুবই কম।

বাজার ডেলিভারি দিতে আসা ভ্যান

বাজার ডেলিভারি দিতে আসা ভ্যান

আমাদের দেশ জনবহুল দেশ। এক ঢাকাতেই প্রায় ২ কোটি লোকের বাস। ভাইরাস দ্রুত ছড়াতে আমাদের সময় লাগবে না। তাছাড়া আমাদের দেশের প্রতিটা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু তা আমরা হালকা অসুস্থ হলেই বুঝতে পারি। ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট যেসব অসুখের সঙ্গে রেস্পিরেটরি ইনফেকশান জড়িত সেসব ভাইরাস বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে (শীতের শুরুতে কিংবা বসন্তের শুরুতে) কেন দেখা দেয় তার পেছনে কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে।

প্রথমত, এসব ভাইরাস কম তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতায় মানবদেহের বাইরে বেশ কয়েকদিন বাঁচতে পারে। দ্বিতীয় কারণটি হলো শীতপ্রধান দেশের লোকেরা শীতের সময়টায় একসঙ্গে থাকতে পছন্দ করে। তৃতীয়ত, শীতকালে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কার্যকর। কারণ এসময় রোদ কম থাকে বলে মানবদেহে ভিটামিন ডি কম তৈরি হয়। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন ডি সবচেয়ে কার্যকরী।

কোভিড-১৯ ভাইরাসের গতিবিধি সম্পর্কে আমরা এখনো সঠিক জানি না। কিছু গবেষণায় এটা ধারণা করা হচ্ছে যে সরাসরি রোগীর কাছাকাছি না আসলে অন্যান্য উপায়ে ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি তাপমাত্রাযুক্ত অঞ্চলে কিছুটা কম হবে, তবে তা ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের জন্য তেমন কার্যকর নাও হতে পারে। অন্যান্য উপায় বলতে বোঝানো হয়েছে কোনো জড় পদার্থে অবস্থানকারী ভাইরাসের জীবনকাল যদি বেশি হয়, তবে তাকে স্পর্শ করলে এবং তারপর চোখ, নাক বা মুখে হাত দিলে সেই ভাইরাস শরীরে সংক্রমিত হয়ে থাকে।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে রোগীর সংখ্যা ৪৪ জন। সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। ইতালিতে প্রথম সপ্তাহে ছিল মাত্র ৭৯ জনের মতো। উচ্চ তাপমাত্রা যদি বরকত হিসেবে কাজ না করে তাহলে আমাদের দেশে করোনা দুর্যোগ ঠেকানো অসম্ভব হয়ে যাবে।

রুটিন করে আমি আর রবি আমাদের বাবা-মায়ের প্রতিদিনের কাজকর্মের খোঁজ নিচ্ছি। এ পরিস্থিতিতে আমরা কী করছি সেই অভিজ্ঞতা তাদের সঙ্গে শেয়ার করছি যেন তারা এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে পারেন। বাসায় থেকে যেন অন্যান্য অসুখ বাঁধিয়ে না ফেলেন তার জন্য ব্যায়ামের ভিডিও পাঠিয়েছি, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে উৎসাহিত করেছি, যেসব কাজ করলে মন ভালো থাকবে তার একটা লিস্ট বানিয়ে একে একে করতে বলেছি। করোনাভাইরাস নিয়ে ভয় নয়, নিজের পরিবার থেকেই সচেতনতা শুরু হোক।

অনলাইনে তো বাজার করছি। ডেলিভারি ম্যান এবং আমাদের উভয়ের সেইফটির কথা মাথায় রেখে বাসার রিসিপশানে ব্যাগগুলো রেখে চলে যায়। তারপর গ্লাভস পরে খুব সাবধানে ব্যাগগুলো ঘরের ভেতরে নিয়ে আসি। ব্যাগগুলো ঘরের একটা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে তাতে জীবাণুনাশক বা ডিজইনফেক্টেন্ট স্প্রে করে কিছুক্ষণের জন্য রেখে দেই। শুকনো জাতীয় খাবারের প্যাকেটগুলো তিন-চারদিনের জন্য ঘরের একটা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেই আর বাকি খাবার যেমন সবজি, ফল কিংবা মাছ মাংসের প্যাকেট বের করে ভালোভাবে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নেই। সেই প্যাকেট খুলে নতুন প্যাকেটে মুড়িয়ে ফ্রিজে রাখি। প্যাকেট এবং ব্যবহৃত গ্লাভস সব গারবেজ করে বাসায় এসে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেই। মনের সন্তুষ্টির জন্য হয়তো আমরা একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করছি।

আমাদের শহরে রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ ঘোষণা দেবার পর দেখেছি বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট মালিক, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিদিন রান্না করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বেশ কিছু তরুণ-তরুণীকে দেখেছি বাজার এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে বয়স্ক ব্যক্তিদের বাড়ি পৌঁছে দেবার মতো কাজ করছিলো, কেউ কেউ হাসপাতালে যারা কাজ করছে তাদের জন্য রান্না করে পাঠিয়ে দিচ্ছিলো। এখন অবশ্য বাইরে চলাফেরায় বেশ কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর সেসব কাজও আগের চেয়ে কম হচ্ছে।

বাংলাদেশের বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক দল দেখলাম নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তাদের উদ্যোগ, পরিশ্রম ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখে আমি উৎসাহ পেয়েছি অনেক, পেয়েছি অন্ধকারে এক ফোঁটা আশার আলো। কিন্তু এই গুটিকয়েক মানুষ কত কোটি মানুষের জন্য করবে? আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের আশপাশের মানুষকে প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করার মানসিকতা থাকা।

এখানে দেখলাম করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ফাইট করার জন্য জর্জিও আরমানি সহ আরো ১৭ জন বিলিওনিয়ার ইতালিকে ৩৩ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছেন। সরকারের পাশাপাশি ছোট বড় সবাই এ লড়াইয়ে জয়ী হবার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করছে।

আজ ২৬ মার্চ পর্যন্ত ইতালিতে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮০ হাজার ৫৮৯। এ মহামারির সঙ্গে লড়াই করতে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যারা জড়িত আছেন তাদের মোট ৫ হাজার ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান, অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভারসহ অন্যান্য হেলথ প্রফেশনাল এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৪১ জন হেলথ প্রফেশনাল। ফ্রন্টলাইনের এতো সংখ্যক হেলথ প্রফেশনাল আক্রান্ত হওয়ার পেছনে ‘পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট’ (পিপিই) এর অপ্রতুলতাই একমাত্র কারণ বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আগের পর্ব

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ৪
 

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ৩
 

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ২
 

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ১

লেখক: পেশায় একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। বসবাস করেন ইতালির পাভিয়া প্রদেশের ভিয়া জিওভান্নি তাভাজ্জানি এলাকায়

চলবে…

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!