২০০৭ সালের ২৪ মে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কে কালিহাতী উপজেলার রাজাবাড়ী এলাকায় গাছ ফেলে গাড়ি আটকে ওই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওইদিনই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি মামলা হয় কালিহাতী থানায়।
মামলার নথিতে বলা হয়, সেদিন রাত ২টার দিকে মামলার বাদী জয়নাল আবেদীন টাঙ্গাইলের শাপলা ক্লিনিকে রোগী রেখে নিজের মাইক্রোবাসে এক নারীসহ দুইজনকে নিয়ে কালিহাতীতে তার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনি দেখেন রস্তায় বৈদ্যুতিক খুঁটি ফেলে ডাকাতি করছে একদল লোক।
বাদী নিজেও ডাকাতের কবলে পড়েন। ১৮/২০ জন ডাকাত তাদের কাছ থেকে সবকিছু নিয়ে যায়। এর মধ্যে তার কাছে থাকা টাকা এবং মানিব্যাগে রাখা লাইসেন্সও ছিল।
টাঙ্গাইলের প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে মামলাটি এখন বিচারাধীন আছে।
শুরুতে মামলার এজাহারে অজ্ঞাত পরিচয় ১৮/২০ জনকে আসামি করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুলিশ সাতজনের নামে অভিযোগপত্র দেয়। তাদের আসামি করেই অভিযোগ গঠন করা হয় ২০১১ সালের ৬ জুন।
আসামিরা হলেন মো. হামিদ, মো. জসীম উদ্দিন, শিবলু ওরফে সিরাজুল ইসলাম, মাসুদুর রহমান মাসুদ, সোহেল রানা, মো. আব্দুল মজিদ ও মো. সুমন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি এস আকবর খান
অভিযোগপত্রের ৫ নম্বর আসামি সোহেল রানার বড় ভাই জুয়েল রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পুলিশ ঘটনাটি তদন্তকালে ইছাপুর এলাকার ওই সময়ের স্কুলছাত্র শিবলু, সোহেল রানা ও মাসুদুর রহমান মাসুদকে সন্দেহজনক হিসেবে গ্রেপ্তার করতে বাড়ি বাড়ি অভিযান চালায়।
“পুলিশ বাড়ি গিয়ে তাদের না পেয়ে আমাকে ও মাসুদের বাবাকে থানায় নিয়ে যায়। পরে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠায়। পরে সোহেল ও মাসুদ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।”
মাসুদের বাবা নূরুল ইসলাম নূরুর অভিযোগ, এখন এলাকায় কোনো চুরি ও ডাকাতির ঘটনা ঘটলেই তাদের বাড়িতে পুলিশ এসে বিভিন্ন প্রশ্ন করে, থানায় গিয়ে দেখা করতে বলে।
“আজও মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি থানায় ডেকে নিয়ে জেলহাজতে পাঠানোর সেই ঘটনা। তাই বাড়িতে পুলিশ এলেই ভয়ে চমকে উঠি।”
এখন দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি হলেই ভোগান্তির শেষ হবে বলে আশা করছেন নুরু।
এই ১৩ বছরে সেই স্কুল ছাত্ররা বড় হয়ে ঘর-সংসার করছেন। এখনও নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
ইছাপুর শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. নূরুল ইসলাম সিকদার বলেন, “২০০৭ সালের মে মাসের ওই ডাকাতির ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে একটি মামলা হয় কালিহাতী থানায়। তারপর হঠাৎ শুনি আমার কয়েকজন ছাত্রকে এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন এই মামলা শেষ হয়ে গেলে তারা রেহাই পেত।”
ইছাপুর গ্রামের বাসিন্দা ও শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবু সাঈদ খান ও সাবেক ইউপি সসদ্য মোশারফ হোসেন সিকদার।
তিনি বলেন, ওই এলাকায় ডাকাতির ঘটনা অনেক ঘটেছে। মামলার আসামি না হয়েও হাজত বাস করেছেন এক আসামির বাবা ও আরেক আসামির বড় ভাই।
“সেই সাথে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে তাদের পরিবার। এর শেষ হওয়া দরকার।”
এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেউ ডাকাতি মামলার চার্জশিটভুক্ত হলে পুলিশ মাঝে-মধ্যে তাদের খোঁজ-খবর নেবে, এটা পুলিশের কাজ। তাই বলে তাদের হয়রানি করা যাবে না।”
এদিকে এই মামলার বাদী জয়নাল আবেদীন এখন বলছেন, তিনি নিজে ওই মামলা করতে চাননি।
তার দাবি, ডাকাতদের কাছ থেকে উদ্ধার করা গাড়ির লাইসেন্স আনতে থানায় গেলে পুলিশ তার স্বাক্ষর নিয়ে রাখে; পরে জানতে পারেন, তিনেই মামলার বাদী।
কালিহাতী উপজেলার কামার্থী গ্রামের জয়নাল আবেদীন বর্তমানে ব্রুনাইয়ে থাকেন। সেখান থেকে তিনি ভিডিও কলের মাধ্যমে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন।
মামলার বাদী জয়নাল আবেদীন
জয়নাল আবেদীন বলেন, “পুলিশ আমারে বাদী দিয়া দিছে আমি জানিই না। আমি গেছি থানায় লাইসেন্স তুলবার নিগা, হেই সময় আমার স্বাক্ষর নিয়া আমারে দিয়া থুইছে বাদী। আমি এই বিষয় জানিই না।”
তিনি বলেন, “আমার গাড়িতে ডাকাতি অয়ছে ঠিক, তাগো তো চিনবার পারি নাই; তারা মুখোশ পরা ছিল। আমি বাদী হমু কিয়ের লিগা।”
এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে কালিহাতী থানা ওসি সওগাতুল আলম বলেন, “যেহেতু মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে, তাই এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নাই।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোশতাক আহম্মেদ বেল্লাল বলেন, ২০১১ সালে মামলার বিচার শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৫৮টি তারিখ গেছে এবং ১১ সাক্ষীর মধ্যে তিনজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে গ্রামের সাধারণ পরিবারের সন্তানরা ছাত্রজীবন শেষ করে কর্মজীবনে এসেও মামলার চালিয়ে নিতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন এই আইনজীবী।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এস আকবর খান বলেন, “এই মামলাটি দ্রুত শেষ করতে আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রস্তুত আছি।”