ক্যাটাগরি

‘বাংলাদেশকে নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে চাই’

ম্যাচ রেফারি হিসেবে আপনার অভিষেক টেস্ট, দেশেরও প্রথম টেস্ট ম্যাচ রেফারি আপনি। দুটি মিলিয়ে অনুভূতি কেমন?

নিয়ামুর রশিদ: বলার অপেক্ষা রাখে
না, কতটা রোমাঞ্চিত আমি। যে স্বপ্ন ও লক্ষ্য নিয়ে ম্যাচ রেফারি হয়েছিলাম, সেটি পূরণ হতে যাচ্ছে। নিজের স্বপ্নপূরণের পাশাপাশি টেস্ট ম্যাচ রেফারি হিসেবে দেশেরও প্রথম আমি, অনেক বড় গর্বের ব্যাপার। আমি মনে করি, যোগ্যতারই প্রতিফলন পড়েছে এতে।

অনেকে বলতে পারেন, এটা কোভিডের আশীর্বাদ। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। কোভিড যেমন অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, তেমনি কিছু দিয়েছেও। এটা সেরকমই কিছু ধরে নিতে পারেন। শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বের মানুষকে অনেক ভুগতে হয়েছে। আবার পরিস্থিতির কারণেই নতুন অনেক কিছু হয়েছে, যা বেশ ইতিবাচক। আমিও এটাকে সেভাবেই নিচ্ছি।

যে পরিস্থিতিতেই আসুক না কেন, এটা আমার জন্য ভালো হয়েছে, সৈকতের (শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ) জন্য ভালো হয়েছে, দেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো হয়েছে। আমরা একটা জায়গায় যেতে পেরেছি বলেই সুযোগটা আমরা পেয়েছি। আশা করি, আমরা ভালো করে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারব। আমার মনে হয়, সবাই মিলে কাজ করতে পারলে ক্রিকেটের এই সেক্টরটিকে আমরা এগিয়ে নিতে পারব।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেওয়া সেই ইতিহাস গড়া জয়ের অংশ ছিলেন আপনি। এবার নতুন এক অধ্যায়ের সূচনাও আপনাকে দিয়ে। দুই সময়কে এক করতে পারেন?

পেশা ব্যাংকিং হলেও ম্যাচ রেফারি হিসেবে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন নিয়ামুর।

পেশা ব্যাংকিং হলেও ম্যাচ রেফারি হিসেবে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন নিয়ামুর।

নিয়ামুর: ইতিহাসের অংশ হতে পারা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। কাকতালীয়ভাবে বলেন বা আল্লাহর রহমত, পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলাম। অবিস্মরণীয় জয়ের স্বাদ পেয়েছিলাম। ক্রিকেটে যা কিছুই করেছি, বাবা-মা, চাচারা পাশে ছিলেন বলে, কোচদের সমর্থন পেয়েছি বলে করতে পেরেছি।

এখন ম্যাচ রেফারি হিসেবে টেস্টে দায়িত্ব পালন করব, এটাও আমার বড় প্রাপ্তি। অনেক দিন থেকেই তো এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলাম। নিজে টেস্ট খেলতে পারিনি, আক্ষেপ ছিল। সেটিই পূরণ করতে চেয়েছিলাম টেস্টে ম্যাচ রেফারি হয়ে। আমি মনে করি, আমার ক্রিকেট জীবন পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে এটি দিয়ে।

যেটি বলছিলাম, ইতিহাস গড়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। এখানে আমিই প্রথম। আর কেউ প্রথম হতে পারবে না, এটা কেউ কেড়ে নিতেও পারবে না। সেদিক থেকে আমি দারুণ ভাগ্যবান।

ম্যাচ রেফারি হিসেবে নিয়মিত কাজ করলেও আপনার পেশা তো ব্যাংকিং। দুটি সামলান কিভাবে?

নিয়ামুর: ম্যাচ রেফারি আমার পেশা নয়। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছি। বিসিবির চুক্তিবদ্ধ নই। তারপরও বিভিন্ন ম্যাচ বা সিরিজে দায়িত্ব পালন করে আসছি। বিসিবি সুযোগ করে দিয়েছে। সেই পথ ধরেই আইসিসির তালিকাবদ্ধ হতে পেরেছি। এজন্য বিসিবির কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার।

এসব করতে হয়েছে আমার মূল পেশাকে ঠিক রেখেই। অবশ্যই আমার প্রতিষ্ঠান থেকে দারুণ সহায়তা পেয়েছি। সাবেক এমডি স্যার আনিস এ খান, এখনকার এমডি মাহবুবুর রহমান স্যার যেভাবে আমাকে সমর্থন করেছেন, কোনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশই যথেষ্ট নয়। আমাদের ব্যাংকের ক্রিকেট দলেরও অধিনায়ক ছিলাম আমি। আমার সরাসরি বস তৌফিকুল আল চৌধুরি আমাকে প্রচুর উৎসাহ দেন, ভরসা দেন।

বিভিন্ন সময়ে আইসিসি-এসিসির টানা টুর্নামেন্টে দায়িত্ব পালন করেছেন নিয়ামুর।

বিভিন্ন সময়ে আইসিসি-এসিসির টানা টুর্নামেন্টে দায়িত্ব পালন করেছেন নিয়ামুর।

একটা ব্যাপার হলো, ব্যাংকের পারফরম্যান্স ঠিক রেখেছি বলেই হয়তো তারা আমাকে ক্রিকেটে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। ব্যাংকিং তো আমার ক্যারিয়ার, এগিয়ে যাওয়া, প্রমোশন, এসবের ব্যাপার আছে। ওখানে সবসময় ভালো করার চেষ্টা করি। ক্রিকেটের জন্য যে ছাড়টুকু পাই, সে কারণে ব্যাংকের প্রতি দায়িত্ববোধ হয়তো আরও বেশি কাজ করে।

আমি এমনিতেও সবসময় যা করি, সবকিছু মন দিয়ে করার চেষ্টা করি। বাড়ির জন্য বাজার করাটাও আমি যে কোনো দায়িত্বের মতো একই গুরুত্ব দিয়ে করি। সবসময় শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন কাটানোর চেষ্টা করি। সময়ানুবর্তিতা দারুণভাবে মেনে চলি, টাইমিং যেটা বলি, সবসময় মেনে চলার চেষ্টা করি। এই শিক্ষা পেয়েছি আমার বেড়ে ওঠার প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি থেকে। সব মিলিয়েই আজকের আমি।

৯টি ওয়ানডে ম্যাচ পরিচালনা করেছেন ম্যাচ রেফারি হিসেবে। টেস্টে দায়িত্ব পালন করতে কতটুকু প্রস্তুত?

নিয়ামুর: আইসিসি ম্যাচ রেফারি হিসেবে চারটি সফর করেছি আমি। খুব বেশি হয়তো নয়, তবে সুযোগ যতটুকুই পেয়েছি, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চেয়েছি। নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছি প্রতিবারই। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে মেয়েদের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কাজ করেছি। মালয়েশিয়ায় ছেলেদের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দায়িত্ব পালন করেছি। যেটা অনেক বড় সুযোগ ছিল আমার জন্য। সবশেষ গতবছর ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ-২ করেছি, যেগুলো ছিল ওয়ানডে। এছাড়াও দেশে মেয়েদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ করেছি। বিভিন্ন সময় বিপিএলসহ ঘরোয়া ক্রিকেট, সফরকারী দলগুলির প্রস্তুতি ম্যাচ ও অন্যান্য টুর্নামেন্টে তো করেছিই।

প্রতিটি টুর্নামেন্টেই বিভিন্ন ধরনের আম্পায়ারের সঙ্গে কথা বলে, দলের সঙ্গে মিশে, কাজ করে অনেক উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন সময় আম্পায়াররা হয়তো ভালো রিপোর্ট দিয়েছে। নানা সময়ে কাজের মূল্যায়ন হয়েছে, এসব হয়তো আমার পক্ষে গেছে। এজন্যই দায়িত্ব পেয়েছি।

টেস্ট ম্যাচ রেফারি হওয়ার স্বপ্নের কথা বলছিলেন। কোভিড পরিস্থিতির আগে কি ভাবতে পেরেছিলেন, এত দ্রুত স্বপ্ন পূরণ হবে? কোভিড না এলে কবে নাগাদ টেস্ট ম্যাচ রেফারি হতে পারতেন বলে মনে হয়?

নিয়ামুর: কোভিডের আগে তো কল্পনাও করতে পারিনি এত দ্রুত হবে। সত্যি কথা যদি বলি, স্বপ্ন তো ছিলই, কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় সেই স্বপ্ন হয়তো পূরণ হতো না কোনোভাবেই। পরিস্থিতিই সুযোগটা করে দিয়েছে। তবে পাশাপাশি এটিও আবার বলছি, পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার মতো অবস্থায় নিজেকে তুলে আনাও জরুরি। বিসিবি অবশ্যই আমাদের নাম পাঠিয়েছে। তবে আইসিসিতে কেবল যোগ্যতাই মানদণ্ড, সেখানে মামা-চাচার জোর চলে না। দায়িত্ব যখন তারা দিয়েছে, নিশ্চয়ই একটা পর্যায়ে যেতে পেরেছি।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার নিয়ামুর।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার নিয়ামুর।

কোভিডের কারণে যখন পরিবর্তিত পরিস্থিতি এলো, তখন আশা জেগেছে। হবেই, এরকম বিশ্বাস ছিল না। তবে কিছু আশা ছিল। এক পর্যায়ে ভাবছিলাম, আমাকে আর শিপার ভাইকে (বিসিবির ম্যাচ রেফারি আখতার আহমেদ) হয়তো ভাগ করে দেবে দায়িত্ব। কিন্তু আইসিসি হয়তো আমার আগের পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন করে আমাকেই দিয়েছে।

এই ম্যাচ দিয়ে টেস্ট ম্যাচ আম্পায়ার হিসেবে অভিষেক হচ্ছে শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদের। তাকে আপনি দীর্ঘদিন ধরে দেখছেন। আম্পায়ার হিসেবে তাকে কোথায় রাখবেন?

সৈকত: বিশ্বাস করতে পারবেন কিনা কিংবা সৈকত নিজেও বিশ্বাস করে কিনা, আমার কাছে সৈকত একটা কমপ্লিট প্যাকেজ। বাংলাদেশের আম্পায়ার বলে হয়তো ততটা মূল্যায়ন হয় না। কিন্তু অল ফিল্ড দায়িত্ব পালন করা বলেন, ওর বোধ ও জ্ঞান বলেন, বক্তা হিসেবে দারুণ, কমিউনিকেশন স্কিল খুব ভালো। সব মিলিয়ে সে অবশ্যই যোগ্য।

সৈকতের পর গাজী সোহেল, মুকুল (মাসুদুর রহমান), তানভির আহমেদ, ওরাও খুব ভালো করছে, কিন্তু এরপর আর ভালো আম্পায়ার আসছে না আমাদের। এই জায়গাটায় ক্রিকেট বোর্ডকে আরও বেশি চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। আরও ম্যাচ রেফারি, আম্পায়ার উঠে এলে আমাদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা হবে, সামগ্রিক মান বাড়বে, দেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাবে। মাঠে আমরা আইসিসির প্রতিনিধিত্ব করি বটে, তবে সেটা বাংলাদেশের মাধ্যমেই।

এবার যে সুযোগ আপনারা দুজন পেলেন, এখানে ভালো করলে ভবিষ্যতে এলিট প্যানেলে জায়গা পাওয়া কতটা সম্ভব?

নিয়ামুর: যোগ্যতার মাপকাঠিতেই আমরা সুযোগ পেয়েছি। তবে অবশ্যই আমাদের জন্য বড় সুযোগ, নিজেদের কাজ দেখানোর। অনেক শেখার আছে, অনেক করার আছে। এখনও আইসিসির ডাটাবেজ নিয়ে বসে আছি, দেখছি, শিখছি। নট আ ম্যাটার অব জোক। অনেক বড় দায়িত্ব। তবে আমরা তা ধারাবাহিকভাবে পালন করার ক্ষমতা রাখি বলেই মনে করি।

এখানে অনেক ব্যাপার আছে। খুঁটিনাটি সবকিছুতে এখন যাচ্ছি না। তবে এটা বাস্তব যে এই জায়গাটিতে বাংলাদেশ মূল্য কম পায়। আমরা চাই সেই চিত্র বদলাতে। যে সুযোগ আমরা পেয়েছি, এটা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে চাই। ওয়ানডেতেও আমাদের জন্য সুযোগ ছিল। আমি মনে করি, আমরা সবাই খুব ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করেছি। এতে ৫০ ভাগ লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। এবার টেস্টে বাকি ৫০ ভাগ পালন করার পালা। তাহলে আশা করি, আমাদের নিয়ে অনেক ধারণা বদলে যাবে।

ক্রিকেটারদের মতো আম্পায়াররাও কিন্তু ফ্রন্ট লাইনার। ক্রিকেটারদের তবু ইনিংস শেষে বেশির ভাগের বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ মেলে। আম্পায়ারদের পুরো ম্যাচ, সব ইনিংসেই মাঠে থাকতে হয়। অনেক সতর্ক থাকতে হয়। কঠিন কাজ। তবে আমরা মনে করি, সবাইকে পাশে পেলে আমরাও সফল হতে পারি।

আমাদের ক্রিকেটাররা যেমন একটু একটু করে এগিয়েছে, একটি-দুটি জয়, এরপর সিরিজ জয়, বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি-ফাইনাল খেলেছে ক্রমে, তাতে ক্রিকেট বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে, সেভাবে আমরাও আশা করি নিজেদের প্রমাণ করব। আমি এলিট প্যানেলে যেতে না পারি, এমন একটা মঞ্চ আমরা তৈরি করে দিতে চাই যেন এরপর বাংলাদেশের কেউ ১০০ টেস্টে ম্যাচ রেফারি বা আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।