ক্যাটাগরি

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ৬

বেশ কয়েকদিন হলো এখানে জানালা দিয়ে নিচে তাকালে ড্যান্ডেলিয়ন দেখতে পাই। কিন্তু ছুঁয়ে দেখা হয় না। প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে আজ ১০ দিন হতে চললো, গাছে গাছে নতুন পাতায় সবুজ হতে শুরু করেছে চারদিক। আমার রান্নাঘরের পাশেই বিশাল এক ঝাউগাছ। বেশ কিছু পাখির বাস এতে। আজকাল চারদিক এতো নিঃস্তব্দ থাকে বলে পাখির কিচিরমিচির বেশ স্পষ্টই শোনা যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের খাঁচায় বন্দি করে তারা অবাধে, নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সেদিন কথা হচ্ছিলো আমার কাজিন সারজাহ’র সঙ্গে। পেশায় চিকিৎসক, বর্তমানে কাজ করছে লন্ডনের দুটো হাসপাতালে। প্রতিদিন অগণিত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী হ্যান্ডেল করছে সে। একমাস আগেও যেসব রোগী আসছিলো মোটামুটি প্রত্যেকেরই চীন বা ইতালিতে ভ্রমণের হিস্ট্রি ছিলো। কিন্তু এখন যেসব রোগী আসছে তাদের প্রত্যেকের কারণ অজানা।

তার মতে কমিউনিটি ট্রান্সমিশানের কারণে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাছাড়া কম বয়সের রোগীর সংখ্যা বেশি। লক্ষণের মাত্রার উপর নির্ভর করে হাসপাতালে ভর্তি করানো হচ্ছে। কম মাত্রার রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করা হচ্ছে। এই মাসে তার ছুটি ছিলো, কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার কারণে সে দিনরাত সময় দিচ্ছে হাসপাতালে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম মেডিক্যাল সরঞ্জামাদি বা হেলথ প্রফেশনালদের সুরক্ষার ব্যবস্থা কেমন। বললো পিপিই (পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট) এর সংকট সেখানেও রয়েছে। হাসপাতাল থেকে হেলথ প্রফেশনালদের অনুরোধ করেছে পরিবার থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে যোগাযোগ করতে। বড় মামা-মামানীর কথা চিন্তা করে সে বাসায় না এসে হাসপাতালের কাছে থাকার কথা ভাবছিলো। অবশ্য এপ্রিল থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের আশপাশে তার থাকার ব্যবস্থা করেছে।

ইতালির এক প্রতিবেদনে শুনছিলাম এখানের হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণে পিপিই না থাকার কারণে এমনও হয়েছে ডাক্তার আইসিইউতে রোগীকে গ্লাভস না পড়েই হ্যান্ডেল করেছেন। ইতালিতে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ৬ হাজারেরও বেশি সংখ্যক হেলথ প্রফেশনাল সংক্রমিত হয়েছেন। তার মধ্যে আজ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪৬ জন। ফ্রন্টলাইনের হেলথ প্রফেশনাল যেমন ডাক্তার, নার্স, মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট সহ অন্যান্যরা যেন রোগীদের সেবা দিয়ে গিয়ে সংক্রমিত না হন, তাই এই ধরনের রোগীদের ‘নেগেটিভ প্রেসার আইসোলেশান রুম’-এ চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে।

কিন্তু ইতালিয় চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, হাসপাতালে এ ধরনের আইসোলশান রুমের সংখ্যাও রোগীর তুলনায় কম। এমনও দেখা গেছে হাসপাতালের অন্যান্য রুমগুলোতেও রোগীদের সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে করে ভাইরাস ছড়ানো যেমন খুব সহজ তেমনি ফ্রন্টলাইনের হেলথ প্রফেশনালদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও বেশি। যারা আমাদের সুস্থ করে তোলার জন্য দিনরাত কষ্ট করে যাচ্ছেন তারাই যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, এতে করে আমরা যে ‘ফ্ল্যাটেনিং দ্য কার্ভ’ এর কথা বলে যাচ্ছি তা সম্ভব না। তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যেসব সামগ্রী প্রয়োজন তা পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে কিনা কিংবা না থাকলে তার নিশ্চয়তা দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমার দেশের গত কয়েকদিনের সংবাদ আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে। হাসপাতালে করোনাভাইরাসের লক্ষণ আছে এমন রোগীকে ভর্তি করছে না, করলেও যারা চিকিৎসা সেবা দিবেন তাদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নেই, ভাইরাস শনাক্তকরণের জন্য পরীক্ষা করানোর উদ্যোগও তেমন দেখছি না। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সবাইকে তার নিজের অবস্থান থেকে কাজ করার সুযোগ করে না দিলে আমাদের যে ক্ষতি হয়ে যাবে তা অপূরণীয়।

বাসায় থাকলে সাধারণত দেখা যায় বেশির ভাগ সময় আমরা আলসেমি করে কাটাতে পছন্দ করি। আমার মনে হয় এই প্রবণতা কম বেশি আমাদের সবার মধ্যে আছে। যেহেতু জিম ব্যবহার করা এই মুহূর্তে ঠিক হবে না তাই বাসায় কিছুটা অ্যাকটিভ থাকা দরকার। অ্যাকটিভ থাকা মানে ত্রিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা কিছু এক্সারসাইজ বা ব্যায়াম করা। ব্যায়ামের কারণে আমাদের শরীরে অঙ্গপ্রতঙ্গ সচল থাকে। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ব্যায়ামের ভূমিকা অনেক। কারণ আমরা যখন কোনো ধরনের এক্সারসাইজ করি তখন আমাদের শরীরের অ্যান্টিবডি ও শ্বেত রক্তকণিকা দ্রুত সঞ্চালিত হয়।

অ্যান্টিবডির কাজ হলো শরীরে প্রবেশকৃত ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়াকে শনাক্ত করা এবং তা নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। আর শ্বেত রক্তকণিকার কাজ হলো সংক্রামক রোগ থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করা। শরীর ভালো রাখার জন্য রবি আর আমি বাসায় নিয়মিত ব্যায়াম করছি। আলসেমি আসলে একজন আরেকজনকে সতর্ক করে দিচ্ছি।

বলা যায় ইতালিতে নতুন রোগীর দৈনিক বৃদ্ধির হার কমেছে। তবে এখনো অ্যাকটিভ কেইস কমতে শুরু করেনি। অর্থাৎ আমরা কার্ভের পিকে যাবার কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছি। আশা করা যায়, আর কিছুদিনের মধ্যে আমরা পিকে পৌঁছাবো। তারপর কার্ভ নিচের দিকে নামতে শুরু করবে। এর মানে যদি সব ঠিকঠাক থাকে অর্থাৎ, একই ট্রেন্ড অনুসরণ করে তবে শূন্যের কোঠায় নামতে আরো কয়েক মাস লাগবে।

দেখলাম করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাবার জন্য আজকাল বহু টোটকা বেরিয়েছে। মানুষ তা যাচাই না করে গিলছেও। এই যেমন রসুন খেলে করোনাভাইরাস ভালো হয়ে যায় কিংবা ডাবের পানিতে প্রতিকার মিলবে করোনাভাইরাসের। ভাবছি কাল এ বিষয়ে লিখবো।

আগের পর্ব

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ১
 

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ২
 

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ৩
 

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ৪
 

করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ৫
 

লেখক: পেশায় একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। বসবাস করেন ইতালির পাভিয়া প্রদেশের ভিয়া জিওভান্নি তাভাজ্জানি এলাকায়

চলবে…