তবে বছরে ‘৭শ থেকে ৮শ’ কোটি’ টাকার রপ্তানিমুখী এই শিল্পের আরও বিকাশে সব সমস্যা সমাধানে পাশে আছে প্রশাসন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, ওমান, ইয়েমেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে আগর-আতর রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের কাঁচামালের উপর নির্ভর করে কুয়েত, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও দুবাইতে চলছে কয়েকটি আগর-আতর কারখানা।
স্থানীয়রা জানান, বড়লেখা উপজেলায় বহু বছর থেকে কয়েকশ পরিবার আগর আতরের ব্যবসা করে আসছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত পঞ্চাশ হাজার মানুষ এই ব্যবসায়ে জড়িত আছে।
বড়লেখা উপজেলার জাতীয় তথ্য বাতায়ন থেকে পাওয়া যায়, বড়লেখার সুজানগর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বহু আগর-আতর কারখানা রয়েছে। সরকারের ‘এক জেলা এক পণ্য’ নীতি হিসেবে মৌলভীবাজারের আগর-আতর শিল্পকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এখানে রয়েছে প্রায় ২০০টির মতো ছোটো-বড়ো কারখানা। এখানকার উৎপাদিত আগর-আতর শতভাগ বিদেশে রপ্তানি হয়।
সম্ভাবনাময় এ সুগন্ধি শিল্প বিকশিত হলে সরকার বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে বলে প্রত্যাশা করা হয়।
তথ্য বাতায়নে আরও পাওয়া যায়, মুঘল আমলে এই পণ্য বেশি ব্যবহার করত। এখনও দেশে-বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমান আগর-আতর চাষিরা তাদের ১০-২০ পূর্বপুরুষ আগে থেকে এই শিল্পে জড়িত।

আগরের আদি জায়গা বড়লেখা হলেও বর্তমানে তা পুরো জেলাতেই ছড়িয়েছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি সরকারের বন বিভাগও এখন অনেকগুলো আগর বাগান করেছে।
আগর আতর উৎপাদনে জড়িত মো. তাফাজ্জল হক ও এমদাদুল হক জানান, আগর গাছ কেটে ছোটো ছোটো ফালি তৈরি করে তা এক মাস পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরে পানি থেকে তুলে বড় ডেগে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় ১০দিন থেকে এক মাস টানা জ্বাল দিতে হয়। ৫০০ লিটারের ডেগে এক মাস জ্বাল দিতে হয়। ১০০ লিটারে ১৫ দিন এবং ২৫ থেকে ৪০ লিটারের ডেগে ১০ দিন জ্বাল দিতে হয়। ডেগ থেকে উপরের পানি বের হওয়ার জন্য বিশেষ একটি আতর পাত্র থাকে যার নাম ‘বখরা’।
বখরার পানিতে ভাসতে থাকে সোনালী রংয়ের সুগন্ধি তেল, যা আতর নামে পরিচিত। পরে বখরা সরিয়ে নিয়ে পানি থেকে সেই সোনালী তেল [আতর] একটি পাত্রে তোলা হয়। পরে পুনরায় পানি সরিয়ে বোতলে রাখা হয়। তিনশ কেজি ফালি থেকে গড়ে ২০ তোলা আতর পাওয়া যায়।
একবার আতর বের হওয়ার পর পুনরায় আরও তিন দিন জ্বাল দিয়ে আরও কিছু আতর সংগ্রহ করা হয়।
এমদাদুল হক বলেন, আগর গাছের সাদা ও কালো দু’টি অংশ থাকে। সাদা অংশের দাম কম এবং কালো অংশের দাম বেশি। সাদা অংশের প্রতি তোলা গড়ে ৩ হাজার টাকা এবং কালো অংশের প্রতি তোলা ৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনসারুল হক বলেন, এই শিল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। সরকার নজর দিলে গার্মেন্টস শিল্পের চেয়ে অধিক জিডিপি আসবে এখান থেকে।
তিনি জানান, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই পেশায় মৌলভীবাজার অর্ধলক্ষাধিক লোক জড়িত। অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা সমিতির আওতায় আসতে পারেননি। তবে মোটামুটি বৃহৎ আকারে এই ব্যবসায় জড়িত ১০৪ জনকে নিয়ে একটি এসোসিয়েশন গঠন করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৭০ জনের মতো আয়কর ও ভ্যাটের আওতায় এসেছেন।
বড়লেখার বিশিষ্ট আগর আতর ব্যবসায়ী সিতাব বক্স বলেন, বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নে আগর আতরের সর্বাধিক কারখানার অবস্থান। এখান থেকে উৎপাদিত শত কোটি টাকার আতর প্রতিবছর পাঠানো হয় মধ্য প্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
তবে প্রতি বছর কী পরিমাণ আতর বিদেশে রপ্তানি হয় তার সঠিক কোনো হিসাব তিনি দিতে পারেননি।

বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আজিজ বলেন, দেশের পাশাপাশি বিশ্ব বাজারেও দিন দিন চাহিদা বাড়ছে পণ্যটির। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, ওমান, ইয়েমেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে আগর-আতর রপ্তানি হয়।
“কুয়েত, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের কয়েকটি আগর-আতর কারখানা রয়েছে যেখানে কাঁচামাল যায় মৌলভীবাজার থেকে।”
শুধু বড়লেখাতেই বছরে আগরের নির্যাস হাজার লিটারের উপরে উৎপাদিত হয় বলে তিনি জানান।
সংগৃহীত তথ্যের বরাত দিয়ে আব্দুল আজিজ বলেন, ২০১৯ সালে জেলা থেকে সাত হাজার লিটার আতর বিদেশে পাঠানো হয়েছে। প্রতি লিটারের গড় দাম ছয় লাখ টাকা হিসেবে যার বাজার মূল্য ৪শ’ কোটি টাকার উপর। অন্যদিকে আগর কাঠ রপ্তানি হয় আরও প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার কেজি, যার বাজার মূল্য ২ থেকে ৩শ’ কোটি টাকা।
বছরে আগর-আতর থেকে ৭ থেকে ৮শ কোটি টাকার লেনদেন হয় জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার এটি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে একদিকে রাজস্ব বাড়বে, অন্যদিকে এই শিল্পের বিকাশে এই এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হবে।
এই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনসারুল হক বলেন, প্রতি বছর আনুমানিক সাত হাজার লিটার আতর এবং ১০ থেকে ১৫ হাজার কেজি কাঠ রপ্তানি হয়। গত বছর তিনি প্রায় আড়াই হাজার লিটার আতর এবং ১২ হাজার কেজি আগর কাঠ বিদেশে পাঠিয়েছেন।
এই শিল্পে সম্ভাবনার পাশাপাশি সমস্যাগুলোও তুলে ধরেন বাংলাদেশ-চায়না চেম্বারের নেতা ইসহাকুল হোসেন সুইট।
তিনি বলেন, প্রথমত এই অঞ্চলে আগর শিল্প সংশ্লিষ্টদের সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে গ্যাস সংযোগ নিয়ে। শিল্প এলাকায় গ্যাস সরবরাহ না থাকায় কাঠ পুড়িয়ে ও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে তারা উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ।

একই সঙ্গে পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব ও সরকারি পৃষ্টপোষকতা না থাকায় বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আতর উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করতে পারছেন না বলেও জানান।
“সরাসরি আতর থেকে পারপিউম দেশে তৈরি হচ্ছে না, যা আমাদের কাঁচা মাল দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র করে থাকে।”
তিনি আরও বলেন, আগর রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হল সাইটিস (কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জারড অব ওয়াইল্ড ফনা অ্যান্ড ফ্লোরা) এবং এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) সনদ পাওয়া। এ সব শর্তের বেড়াজালে অনেক আতর ব্যবসায়ী আটকা পড়েন। ফলে অনেকে বাধ্য হচ্ছেন চোরাই পথে আতর রপ্তানি করতে।
ঢাকার ব্যবসায়ী জিয়া হায়দার মিঠু বলেন, বড়লেখার আগর আতরের কাঁচামালকে সামনে রেখে তিনি মৌলভীবাজার বিসিক শিল্প নগরীতে অত্যাধুনিক আগর আতরের ফ্যাক্টরি করেছেন। দেশের এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে ধরে রাখা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তার মূল উদ্দেশ্য।
তিনি প্রথম দফায় কার্যক্রম শুরু করে উন্নতমানের আতর পেয়েছেন। তার এই প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু লোকের কর্মসংস্থানও করতে পেরেছেন।
বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম আল ইমরান জানান, করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মধ্যে আগর আতর ব্যবসায়ীরা যে সমস্যায় পড়েছেন তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তিনি অবগত করেছেন।
ইতিমধ্যে এর পরিস্থিতি জানতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি টিম এলাকা পরিদর্শন করেও গেছেন। এই সময় ওই টিম বর্তমান অবস্থার পাশাপশি অন্যান্য সমস্যাগুলো সম্পর্কেও অবহিত হয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে এই বিষয়ে ভালো সাড়া পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা করছেন।
মৌলভীবাজারের ডিসি মীর নাহিদ আহসান বলেন, এটি শুধু বড়লেখা নয়, দেশেরই একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। যে সব শিল্প রপ্তানিযোগ্য সরকার সেগুলোকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যে একাধিক বৈঠক এবং সরজমিনে ব্যবসায়ীদের যে সব প্রতিবন্ধকতা পরিদর্শন করা হয়েছে সেগুলো সমাধানেও সরকার গুরুত্ব সহকারে কাজ করছে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, আগর একটি গাছের নাম। পৃথিবীতে কবে কোথায় আগর-আতরের চাষাবাদ শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস বের করা মুশকিল। তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রেইন ফরেস্টই আগর গাছের আদিস্থান হিসেবে ধরা হয়। আগর গাছ থেকে বিশেষ কালো রঙের কাঠ পাওয়া যায়, যা আগর কাঠ নামে পরিচিত।
আগর গাছ লম্বায় প্রায় ১৫ থেকে ৪০ মিটার এবং বেড় ০.৬-২.৫ মিটার হয়। শাখা-প্রশাখবিহীন সোজা লম্বা গাছটি দেখতে এবং আকার আকৃতিতে অনেকটা শাল বা গজারি গাছের মতো। এ গাছে সাদা রঙের ফুল এবং ফলগুলো ক্যাপসুল আকৃতির হয়। আগর গাছের পাতা দেখতে অনেকটা লিচু গাছের পাতার মতো। সাদা রঙের আগর কাঠ খুব নরম হয়। ফলে আতর উৎপাদনের উপকরণ সংগ্রহ ও জ্বালানি কাঠ ছাড়া অন্য কোনো কাজে এ গাছ ব্যবহৃত হয় না।