ক্যাটাগরি

সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের বিবৃতি

বুধবার নিজেদের দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বিষয়গুলো গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। সংবাদ সম্মেলনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ বিবৃতি প্রকাশ করা হল।

 

সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের অদ্ভুত চেষ্টা

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আপনাদের সামনে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। গত দেড় দশক ধরে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়েই আজ আমরা এ অবস্থানে পৌঁছেছি।

এই পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহলের চাপ এসেছে, সেসব সামলেই পক্ষপাতমুক্ত থেকে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

কোনো সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য, অথবা প্রকাশিত সংবাদ মুছে দেওয়ার জন্য (ডিলিট) মহল বিশেষের প্রস্তাব, কখনও প্রলোভন এবং শেষ পর্যন্ত হুমকি পাওয়ার অভিজ্ঞতা প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমেরই কমবেশি আছে, তা আমরা জানি।

কিন্তু সর্বশেষ যে দাবিতে এবং যেভাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তা এতটাই অযৌক্তিক, এতটাই উদ্ভট যে বিষয়গুলো অন্য সব সংবাদমাধ্যমকেও জানানোর প্রয়োজন আমরা অনুভব করছি।

কী চায় তারা?

গত এক যুগে বিভিন্ন সময়ে একজন ব্যবসায়ী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আদালতে বিভিন্ন মামলা হয়েছে, সেসব মামলার কার্যক্রম, রায় ও আদেশ নিয়ে অন্য সব সংবাদ মাধ্যমের মত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সেসব মামলায় তারা অনেক আগেই খালাস পেয়ে গেছেন। কিন্তু ইন্টারনেটে পুরনো সেসব মামলার খবর থেকে যাওয়ায় ব্যবসার সমস্যা হচ্ছে বলে তারা দাবি করছেন। সে কারণে তারা চান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পুরনো প্রতিবেদনগুলো সরিয়ে ফেলা হোক। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিজস্ব কোনো অনুসন্ধান এসব প্রতিবেদনে নেই; সম্পূর্ণভাবে মামলার কার্যক্রম ও আদালতের আদেশই সেখানে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাহলে কোন যুক্তিতে একটি সংবাদমাধ্যম এসব প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলবে? ভুল থাকলে আমরা সংশোধন করে নিতে পারি, কিন্তু তেমন কিছু আমাদের নজরে আনা হয়নি।  

আমাদের বার বার বলা হয়েছে, অন্যরাও নাকি এ বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলেছে। বিভিন্নভাবে তদবির করানো হয়েছে প্রভাবশালীদের দিয়ে, যাদের মধ্যে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও আছেন। বলা হয়েছে, তারা সরিয়ে ফেলেছেন, আমরা কেন তা করছি না।

দীর্ঘদিন নানাভাবে চেষ্টার পরও প্রতিবেদন সরাতে রাজি করাতে না পেরে এখন তারা চাপ দেওয়ার অদ্ভুত এক কৌশল নিয়েছেন। বিভিন্ন জেলা থেকে স্থানীয় আইনজীবীদের মাধ্যমে উকিল নোটিস পাঠানো হচ্ছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ সম্পাদকদের নামে।

সেখানে বলা হচ্ছে, ওইসব পুরনো প্রতিবেদনের কারণে সেই ব্যবসায়ীর সম্মানহানী হচ্ছে। প্রতিবেদনগুলো সরিয়ে না নিলে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে’ মামলা করা হবে।

কারা চাপ দিচ্ছে?

গত দুই সপ্তাহে বিভিন্ন জেলা থেকে এরকম তিন ডজন উকিল নোটিস এসেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কার্যালয়ে। ভিন্ন ভিন্ন নামে পাঠানো হলেও সবগুলো নোটিসের ভাষা, বক্তব্য ও দাবি একই রকম।

যেসব প্রতিবেদন তুলে ফেলার জন্য জেলায় জেলায় মামলা করার এই হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সেসব প্রকাশিত হয়েছিল ব্যবসায়ী ও সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এইচ বি এম ইকবাল এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে হওয়া বিভিন্ন মামলায় আদালতের আদেশ নিয়ে।

এর মধ্যে ২০১০ সালে একটি হত্যা মামলা থেকে ডা. ইকবালের খালাসের রায় নিয়ে যেমন প্রতিবেদন আছে, তেমনি দুদকের মামলায় ২০১৭ সালে তার স্ত্রী সন্তানদের হাই কোর্টে আপিল করার অনুমতি পাওয়ার খবরও আছে। 

এ দুটি প্রতিবেদনের কথা এখানে বলার কারণ, প্রথম উকিল নোটিসের সঙ্গে সেগুলোর অনুলিপি তারা পাঠিয়েছে।

এর বাইরেও ২০০৭ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বিভিন্ন তারিখ উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, সেসব তারিখে তাকে বা তার পরিবারকে নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’। কিন্তু কোনো খবরের কোনো নির্দিষ্ট অংশ নিয়ে কোনো আপত্তির কথা তারা বলছেন না।

যারা উকিল নোটিস পাঠাচ্ছেন, তারা নিজেদের ডা. ইকবালের বন্ধু বা সহৃদ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের দাবি, এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করে এইচ বি এম ইকবাল এবং তার পরিবারের ‘সম্মানহানী’ করা হয়েছে।

মামলার কার্যক্রম ও আদালতের আদেশ নিয়ে যেসব খবর বাংলাদেশের মূল ধারার সব সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করেছে, সেই একই খবর প্রকাশের জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে ‘উদ্দেশ্যমূলক সম্মানহানী’ ঘটানোর অভিযোগ করা হচ্ছে।

প্রথম উকিল নোটিসটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম হাতে পেয়েছিল গত মাসের শেষে। বিষয়টি নিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করি আমরা। সাংবাদিকতার নিয়ম অনুযায়ী নোটিসদাতা আইনজীবী এবং ডা. এইচ বি এম ইকবালের সঙ্গে আমাদের প্রতিবেদক কথা বলেন।

প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন করলে সাবেক এই সাংসদ তখন বলেছিলেন, “আমাদের ওয়ান-ইলেভেনের কেইস আজকে ১২ বছর হয়ে গেছে। এগুলো হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোয়াশ-আউট করে দিছে, আপনারা লোয়ার কোর্টের এটা সারা পৃথিবীতে জানায় রাখতেছেন।”

ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন জেলা থেকে নতুন নতুন উকিল নোটিস আসা শুরু হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত ২৪ জেলা থেকে ৩৬টি নোটিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঠিকানায় পৌঁছেছে। সেখানে পুরনো বক্তব্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনটি নিয়ে তাদের আপত্তির কথা।  

নতুন নোটিসগুলোতে বলা হচ্ছে ওই প্রতিবেদনও নাকি ‘ভিত্তিহীন’; অথচ তাদের পাঠানো নোটিস এবং তাদের বক্তব্যের ভিত্তিতেই ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে!

এর মধ্যে ফরিদপুর থেকে পাঠানো একটি নোটিসে বলা হয়েছে, “অত্র লিগ্যাল নোটিস দ্বারা এই মর্মে আরও সতর্ক করা যাইতেছে যে, এরপর কোনোরূপ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন করিলে আমার মোয়াক্কেল, আপনাদের ও আপনাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য থাকিবেন। আপনারা আপনাদের প্রকাশিত সংবাদের ব্যাপারে ভুল স্বীকার পূর্বক বিজ্ঞপ্তি প্রদান করিবেন। অন্যথায় বিরূপ পরিণতির জন্য আপনারা দায়ী থাকিবেন।” 

একটি আইনি নোটিসে যেভাবে ‘বিরূপ পরিণতির’ জন্য প্রস্তুত থাকার হুমকি দেওয়া হল, তা কতটা আইনসঙ্গত হল, সে প্রশ্ন আমরা রাখতে চাই।

 

তাদের উদ্দেশ্য কী

২০০৭-০৮ সময়ে সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের আমল থেকেই বিভিন্ন সময়ে এরকম কয়েক ডজন দাবির মুখোমুখি হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। কখনো প্রতিবেদন সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রলোভন দেখানো হয়েছে, তাতে কাজ না হলে উকিল নোটিসের নামে চাপ দেওয়া হয়েছে।

সেসব নোটিস এসেছে কখনও দেশ থেকে, কখনও বিদেশ থেকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর পেছনে ছিল বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, মূলত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই এসব চাপ এসেছে, রাজনীতিবিদদের দিক থেকে নয়।

কিন্তু এবার যে বিষয়টি আমাদের সামনে এসেছে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের শীর্ষস্থানীয় চারজন সম্পাদকের নামে যে ভাষায় উকিল নোটিস পাঠানো হচ্ছে, তা পড়লে যে কেউ বিস্মিত হবেন। যুক্তি, বাস্তবতা, নিয়ম বা প্রথার কোনো ধার তারা ধারছেন না।

জেলায় জেলায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, যে আইনের দুর্বলতা ও অপব্যবহারের সুযোগ নিয়ে শুরু থেকেই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো কথা বলে আসছে।

আইনটি হওয়ার সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেছিলেন, “এই নতুন আইনের কিছু অংশ গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ সেসবের সুযোগে আইনের অপব্যবহারের ঘটনা আগের (তথ্যপ্রযুক্তি আইন) তুলনায় আরও বেশি ঘটবে বলেই মনে হয়।”

এসব উকিল নোটিসের প্রতিটিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে মানহানির মামলা করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সব অংক যোগ করলে তা ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

এসব নোটিস পাঠাচ্ছেন কারা? যার সংক্ষুব্ধ হওয়ার কথা তিনি নন, অন্য কেউ।

এর উদ্দেশ্য আমাদের হয়রানি করা; ভয় দেখানো, যাতে আমরা প্রতিবেদনগুলো সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবি। এবং তাদের বিষয়ে ভবিষ্যতে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রেও আমরা যেন ভয়ে থাকি।

কথা হচ্ছে, ক্ষমতাধরদের পক্ষ থেকে এ ধরনের চাপ কেন থাকবে। হুমকি দেওয়া, ভয় দেখানোর এই সংস্কৃতির শেষ হতে হবে।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, এ ধরনের চাপের পেছনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সমর্থন বা ইন্ধনও থাকে।

সংবাদ সম্মেলন ডেকে আমরা বিষয়টি আপনাদের নজরে আনছি এ কারণে নয়, যে আমরা হুমকিতে ভয় পেয়ে গেছি। 

বিষয়গুলো আপনাদের সামনে আনছি, কারণ আমরা মনে করছি, এবারের ঘটনাটি অস্বাভাবিক, অবাস্তব এবং সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

মামলা হওয়ার বহু বছর পর তাতে খালাস পেয়ে কেউ যদি ওই মামলার পুরনো সব প্রতিবেদন সরিয়ে নেওয়ার দাবি তোলেন, বিষয়টি নিয়ে আইনি লড়াইয়ের অবতারণা করেন, তাহলে তার প্রভাব প্রতিটি গণমমাধ্যমের ওপরই পড়বে।

 

সবাইকে ধন্যবাদ।

 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১