তিনি বলেছেন, “ভুল হলে আমরা স্বীকার করব, সংশোধন করার প্রয়োজন হলে সংশোধন করে দেব, কিন্তু চাপের কাছে নতি স্বীকার করে আমরা কোনো খবর তুলে নেব না।”
পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ওই চাপের বিষয়গুলো জানাতে বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রধান সম্পাদক খালিদী।
তার সঙ্গে ছিলেন হেড অব ইংলিশ নিউজ অরুণ দেবনাথ, বার্তা সম্পাদক জাহিদুল কবির এবং বার্তা সম্পাদক মুনীরুল ইসলাম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পুরনো সংবাদ মুছে ফেলার জন্য চাপ দেওয়ার কৌশল হিসেবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই শীর্ষ চার সম্পাদকের নামে বিভিন্ন জেলা থেকে তিন ডজনের বেশি উকিল নোটিস সোমবার পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে। সেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং মানহানির অভিযোগে মামলা করারও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
লিখিত বক্তব্যে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিজস্ব কোনো অনুসন্ধান এসব প্রতিবেদনে নেই; সম্পূর্ণভাবে মামলার কার্যক্রম ও আদালতের আদেশই সেখানে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাহলে কোন যুক্তিতে একটি সংবাদমাধ্যম এসব প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলবে?”
“আমাদের বার বার বলা হয়েছে, অন্যরাও নাকি এ বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলেছে। বিভিন্নভাবে তদবির করানো হয়েছে প্রভাবশালীদের দিয়ে, যাদের মধ্যে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও আছেন। বলা হয়েছে, তারা সরিয়ে ফেলেছেন, আমরা কেন তা করছি না। দীর্ঘদিন নানাভাবে চেষ্টার পরও প্রতিবেদন সরাতে রাজি করাতে না পেরে এখন তারা চাপ দেওয়ার অদ্ভুত এক কৌশল নিয়েছেন।”
সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের বিবৃতি
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত দুই সপ্তাহে ২৪টি জেলা থেকে অন্তত ৩৬টি উকিল নোটিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে পৌঁছেছে। ভিন্ন ভিন্ন নামে পাঠানো হলেও সেগুলোর ভাষা, বক্তব্য ও দাবি একই রকম।
যেসব প্রতিবেদন তুলে ফেলার জন্য জেলায় জেলায় মামলা করার ‘হুমকি’ দেওয়া হচ্ছে, সেসব প্রকাশিত হয়েছিল ব্যবসায়ী ও সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এইচ বি এম ইকবাল এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে হওয়া বিভিন্ন মামলায় আদালতের আদেশ নিয়ে।
এর মধ্যে ২০১০ সালে একটি হত্যা মামলা থেকে ডা. ইকবালের খালাসের রায় নিয়ে যেমন প্রতিবেদন আছে, তেমনি দুদকের মামলায় ২০১৭ সালে তার স্ত্রী সন্তানদের হাই কোর্টে আপিল করার অনুমতি পাওয়ার খবরও আছে।
তৌফিক খালিদী বলেন, “এর বাইরেও ২০০৭ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বিভিন্ন তারিখ উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, সেসব তারিখে তাকে বা তার পরিবারকে নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’। কিন্তু কোনো খবরের কোনো নির্দিষ্ট অংশ নিয়ে কোনো আপত্তির কথা তারা বলছেন না।”
যেসব খবর সরিয়ে ফেলার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর একটি তালিকাও সাংবাদিকদের সরবরাহ করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, যারা উকিল নোটিস পাঠাচ্ছেন, তারা নিজেদের ডা. ইকবালের বন্ধু বা সুহৃদ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের দাবি, এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করে এইচ বি এম ইকবাল এবং তার পরিবারের ‘সম্মানহানী’ করা হয়েছে।
“মামলার কার্যক্রম ও আদালতের আদেশ নিয়ে যেসব খবর বাংলাদেশের মূল ধারার সব সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করেছে, সেই একই খবর প্রকাশের জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে ‘উদ্দেশ্যমূলক সম্মানহানী’ ঘটানোর অভিযোগ করা হচ্ছে,” বলেন প্রধান সম্পাদক।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপের বিষয়ে জানাতে বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
কী ঘটেছে আসলে?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলছে, গত এক যুগে বিভিন্ন সময়ে ডা. এইচ বি এম ইকবাল ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেসব মামলার কার্যক্রম, রায় ও আদেশ নিয়ে অন্য সব সংবাদ মাধ্যমের মত তারাও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সেসব মামলায় ডা. ইকবাল ও তার পরিবারের সদস্যরা বহু আগেই আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। কিন্তু এখন সাবেক এই সাংসদের ‘বন্ধু ও সুহৃদ’ পরিচয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে উকিল নোটিস পাঠিয়ে পুরনো সেসব প্রতিবেদন মুছে ফেলতে বলা হচ্ছে।
এসব উকিল নোটিসের মোদ্দা কথা হল, যেহেতু তারা আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, সেহেতু, তাদের দাবি অনুযায়ী, ওইসব মামলা নিয়ে পুরনো প্রতিবেদনও আর রাখা যাবে না। তাদের এমন দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ বলছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়, প্রথম উকিল নোটিসটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম হাতে পেয়েছিল গত মাসের শেষে। বিষয়টি নিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়। সাংবাদিকতার নিয়ম অনুযায়ী নোটিসদাতা আইনজীবী এবং ডা. এইচ বি এম ইকবালের সঙ্গে সে সময় কথা বলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক।
ডা. ইকবালকে উদ্ধৃত করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “আমাদের ওয়ান-ইলেভেনের কেইস আজকে ১২ বছর হয়ে গেছে। এগুলো হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোয়াশ-আউট করে দিছে, আপনারা লোয়ার কোর্টের এটা সারা পৃথিবীতে জানায় রাখতেছেন।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলছে, ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন জেলা থেকে নতুন নতুন উকিল নোটিস আসা শুরু হয়। সেখানে পুরনো বক্তব্যের সঙ্গে ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনটিকেও ‘ভিত্তিহীন’ আখ্যায়িত করে নতুন করে হুমকি দেওয়া হয়।
এর মধ্যে ফরিদপুর থেকে পাঠানো একটি নোটিস থেকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, “অত্র লিগ্যাল নোটিস দ্বারা এই মর্মে আরও সতর্ক করা যাইতেছে যে, এরপর কোনোরূপ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন করিলে আমার মোয়াক্কেল, আপনাদের ও আপনাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য থাকিবেন। আপনারা আপনাদের প্রকাশিত সংবাদের ব্যাপারে ভুল স্বীকার পূর্বক বিজ্ঞপ্তি প্রদান করিবেন। অন্যথায় বিরূপ পরিণতির জন্য আপনারা দায়ী থাকিবেন।”
একটি আইনি নোটিসে এভাবে ‘বিরূপ পরিণতির’ জন্য প্রস্তুত থাকার ‘হুমকি’ দেওয়া কতটা আইনসঙ্গত হতে পারে, সেই প্রশ্নও তোলা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সংবাদ সম্মেলনে।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপের বিষয়ে জানাতে বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা।
কেন চাপ
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলছে, ২০০৭-০৮ সময়ে সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের আমল থেকেই বিভিন্ন সময়ে এরকম কয়েক ডজন দাবির মুখোমুখি তাদের হতে হয়েছে। কখনো প্রতিবেদন সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রলোভন দেখানো হয়েছে, তাতে কাজ না হলে উকিল নোটিসের নামে চাপ দেওয়া হয়েছে।
তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, সেসব নোটিস এসেছে কখনও দেশ থেকে, কখনও বিদেশ থেকে। আর এসব চাপ এসেছে মূলত বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, রাজনীতিবিদদের দিক থেকে নয়।
“কিন্তু এবার যে বিষয়টি আমাদের সামনে এসেছে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের শীর্ষস্থানীয় চারজন সম্পাদকের নামে যে ভাষায় উকিল নোটিস পাঠানো হচ্ছে, তা পড়লে যে কেউ বিস্মিত হবেন। যুক্তি, বাস্তবতা, নিয়ম বা প্রথার কোনো ধার তারা ধারছেন না।”
যে মামলায় একজন অব্যাহতি পেয়ে গেছেন, সেই মামলার পুরনো খবর সরিয়ে ফেলতে কেন তিনি চাপ দিতে পারেন?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, “ইন্টারনেটে পুরনো মামলার খবর থেকে গেলে ব্যবসার সমস্যা হয় বলে তারা দাবি করেন। সে কারণে তারা চান, পুরনো প্রতিবেদনগুলো সরিয়ে ফেলা হোক।”
পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপের বিষয়ে জানাতে বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
কেন সংবাদ সম্মেলন
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়, “কোনো সংবাদ না প্রকাশ করার জন্য, অথবা প্রকাশিত সংবাদ মুছে দেওয়ার জন্য (ডিলিট) মহল বিশেষের প্রস্তাব, কখনও প্রলোভন এবং শেষ পর্যন্ত হুমকি পাওয়ার অভিজ্ঞতা প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমেরই কমবেশি আছে, তা আমরা জানি।
“কিন্তু সর্বশেষ যে দাবিতে এবং যেভাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তা এতটাই অযৌক্তিক, এতটাই উদ্ভট যে বিষয়গুলো অন্য সব সংবাদমাধ্যমকেও জানানোর প্রয়োজন আমরা অনুভব করছি।”
তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, তাদের বিরুদ্ধে সেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, যে আইনের দুর্বলতা ও অপব্যবহারের সুযোগ নিয়ে তিনি শুরু থেকেই কথা বলে আসছেন।
“আইনটি পাস হওয়ার সময় আমি একাধিকবার এ নিয়ে কথা বলেছি। এই নতুন আইনের কিছু অংশ একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ সেসবের সুযোগে আইনের অপব্যবহারের ঘটনা আগের (তথ্যপ্রযুক্তি আইন) তুলনায় আরও বেশি ঘটবে বলেই মনে হয়।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এসব উকিল নোটিসের প্রতিটিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে মানহানির মামলা করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সব অংক যোগ করলে তা ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
“এসব নোটিস পাঠাচ্ছেন কারা? যার সংক্ষুব্ধ হওয়ার কথা তিনি নন, অন্য কেউ। এর উদ্দেশ্য আমাদের হয়রানি করা; ভয় দেখানো, যাতে আমরা প্রতিবেদনগুলো সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবি। এবং তাদের বিষয়ে ভবিষ্যতে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রেও আমরা যেন ভয়ে থাকি।”
তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “কথা হচ্ছে, ক্ষমতাধরদের পক্ষ থেকে এ ধরনের চাপ কেন থাকবে। হুমকি দেওয়া, ভয় দেখানোর এই সংস্কৃতির শেষ হতে হবে।”
এ ধরনের চাপের পেছনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সমর্থন বা ইন্ধনও যে থাকে, সেই অভিজ্ঞতা হওয়ার কথাও তিনি বলেন।
“সংবাদ সম্মেলন ডেকে আমরা বিষয়টি আপনাদের নজরে আনছি এ কারণে নয়, যে আমরা হুমকিতে ভয় পেয়ে গেছি। বিষয়গুলো আপনাদের সামনে আনছি, কারণ আমরা মনে করছি, এবারের ঘটনাটি অস্বাভাবিক, অবাস্তব এবং সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”
সংবাদকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, “মামলা হওয়ার বহু বছর পর তাতে খালাস পেয়ে কেউ যদি ওই মামলার পুরনো সব প্রতিবেদন সরিয়ে নেওয়ার দাবি তোলেন, বিষয়টি নিয়ে আইনি লড়াইয়ের অবতারণা করেন, তাহলে তার প্রভাব প্রতিটি গণমমাধ্যমের ওপরই পড়বে।”
প্রতিবেদন তোলা হবে কোন যুক্তিতে?
লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হওয়া এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তৌফিক খালিদী বলেন, বাংলাদেশে এভাবে চাপটা দেওয়ার সুযোগ কেউ কেউ পাচ্ছেন, কারণ কিছু কিছু গণমাধ্যম চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে।
“আমার কাছে যারা তদবির নিয়ে এসেছেন, সাংবাদিক বা গণমাধ্যমে পরিচিত ব্যক্তি, জাতীয়ভাবে পরিচিত ব্যক্তি, তাদের কেউ অনুরোধ করেছেন, খুব বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করেছেন। তাদের একটা যুক্তি ছিল, সবাইতো তুলে ফেলেছে, আমরা কেন তুলছি না? বড় কাগজ বলে যারা পরিচিত, বা আমাদের ধারণায় যেগুলো বড় কাগজ, এসব কাগজগুলোর নাম উল্লেখ করে তারা বলেছেন, ‘তারাও তুলে ফেলেছে, আপনারা কেন তুলছেন না?’
“আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কোন যুক্তিতে তুলব। কোন নীতির ভিত্তিতে করব, কোন প্রিন্সিপল ফলো করব, কোন ক্রাইটেরিয়া ফলো করব, কিসের ভিত্তিতে? তাহলেতো আমাদের সব তুলে ফেলত হবে, কিছুই থাকবে না।”
ওই ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সাংবাদিককে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, “আপনি যে দেশে আছেন, সেখানে এগুলো চিন্তাই করা যায় না। আমাদের দেশ ধীরে ধীরে সে জায়গায় যাবে। আমরা এই ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে চাই। আমরা অনেক ক্ষেত্রে তো নেতৃত্ব দিয়েছি, অনেক ক্ষেত্রে আমরাই প্রথম করেছি, শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বেও প্রথম হয়েছি। আমার মনে হয় এক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দেব, আমরা কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করব না।”
নিজের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, “আর্কাইভে এই সব তথ্য থাকবে। তরুণ সহকর্মীদের জন্য থাকবে, ভবিষ্যতে গবেষণার জন্য থাকবে। তারা যখন ভবিষ্যতে প্রতিবেদন করবে, সেটার পটভূমি জানার জন্য থাকবে। এই জিনিসগুলো থাকবে।”
হুমকিদাতারা মামলা করলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আইনি পথেই লড়বে জানিয়ে প্রধান সম্পাদক বলেন, “বিচারকতো অন্ধ নন। বিচারকতো জানেন, বিচারকতো দেখবেন যে, আসলে এটা গ্রহণযোগ্য মামলা কি-না”
যেসব উকিল নোটিস পাঠানো হয়েছে, সেগুলোতে ‘সারবস্তু কিছু নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিছুই নেই এর মধ্যে। কী (তারা) বলছেন, তার কোনো ধারও ধারেননি তারা।… কারণ উকিল নোটিস তৈরি করার জন্য যথেষ্ট ম্যাটেরিয়াল, যথেষ্ট যুক্তি, যথেষ্ট তথ্য তাদের কাছে নেই। এবং তার কারণও নেই। অযৌক্তিক, অবাস্তব, উদ্ভট, অদ্ভুত একটা বিষয়। সেই চাপের কাছে আমরা কেন নতি স্বীকার করব?
“হ্যাঁ, একটা কঠিন আইনের ভয় দেখানো হয়েছে, আইনটা কি? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। কারণ এটার মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করতে পারে; এটার মাধ্যমে বলতে পারে যে, ‘আপনি গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন’, তাহলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীতে? কখনোই হবে না। তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নামে যা ইচ্ছা তাও করা যাবে না।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এখন কী পদক্ষেপ নেবে, সেই প্রশ্ন রেখেছিলেন একজন সাংবাদিক। জবাবে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন, উকিল নোটিসেরও জবাব দেওয়া হচ্ছে।
”সৌভাগ্য হচ্ছে, উকিল নোটিসের ভাষা একই হওয়াতে ৩৬টি লিখতে হচ্ছে না আলাদা করে। ফরিদপুর থেকে যেটা পাঠানো হয়েছে সেটাতে একটু হুমকি আছে। আমরা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করব। আইনের প্রতি আমরা সব সময় শ্রদ্ধাশীল থেকেছি। কখনও আইন ভাঙার চেষ্টা করিনি। সেটা সাংবাদিকতার আইন হোক বা অন্য যে কোনো আইন।”
চাপ অনুভব করায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সংবাদ সম্মেলন করল কি না- এমন প্রশ্নে প্রধান সম্পাদক বলেন, “একটা চাপ আছে যে, আমাকে বা আমাদের আইনজীবীকে এইগুলোর জবাব দিতে হচ্ছে, কারণ এগুলো আইনি নোটিস, উকিল নোটিস, এগুলোর জবাব দিতে হবে, এটা একটা কাজ, এটা একটা চাপ। তবে, আমরা ভয় পাইনি, আতঙ্কিত হইনি।”
ডা. ইকবালের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নেবে কিনা- সেই প্রশ্ন করেছিলেন একজন সাংবাদিক।
উত্তরে তৌফিক খালিদী বলেন, “এক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, তিনি (ইকবাল) সরাসরি কিছু করছেন না। তার পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলা থেকে অন্যরা করছেন। যারা নিজেদেরকে তার বন্ধু, সুহৃদ, শুভাকাঙ্খী হিসাবে পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কি-না আমার সন্দেহ আছে। এগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট। আমরা সাংবাদিক হিসাবে জানি বিষয়গুলো কী, আপনারাও জানেন। তার পক্ষ থেকে অন্যরা এসব চিঠি লিখছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে কেউ একজন সমন্বয় করছেন। সেটা কে করছেন সেটা আমি জানি না। আমরা শুধু অনুমানই করতে পারি। আর অনুমানের ভিত্তিতে আমরা কোনো কথা বলি না, লিখিও না।”
তিনি বলেন, “বহু ব্যবসায়ী বিভিন্ন সময় এরকম তদবির করেছেন, আবদার করেছেন, কাউকে দিয়ে বলিয়েছেন। গত ১২/১৩ বছর ধরে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর ইমেইল পাই, বিদেশি নাম লেখা উকিলের নোটিস, যেন দেখে ভয় টয় পেয়ে যাই।… উকিল নোটিসের তো সারমর্ম থাকতে হবে, ভিত্তি থাকতে হবে “
চাপ দেয় কারা
গত ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তৌফিক খালিদী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সংবাদ প্রতিবেদন সরানোর জন্য চাপ আসে মূলত বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর কাছ থেকে, রাজনীতিবিদদের দিক থেকে সেভাবে নয়।
এ বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি বলেন, “এর কারণ হচ্ছে- রাজনীতিবিদরা এসবের তোয়াক্কা করছেন না। এখনকার যিনি প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। সেটি ইতিহাসের অংশ।
“আমার বিরুদ্ধে উদ্ভট সব অভিযোগ তুলে একটি মামলা হয়েছে। অনেক রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। তারা চাপ তো দূরের কথা, কেউ অনুরোধও করেননি যে ওই মামলাটির কার্যক্রম নিয়ে যে রিপোর্ট হয়েছিল সেগুলো তুলে নাও। কখনও তারা বলেননি।”
সেগুলোকে ‘ইতিহাসের অংশ’ হিসাবে বর্ণনা করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, “এগুলো সবই আমাদের আর্কাইভে আছে। এখানে যারা আছেন, তাদের অনেকে তখন সাংবাদিকতাই শুরু করেননি। তারা তথ্য খুঁজতে কোথায় যান? এই আর্কাইভে যান।
“কারও একটা প্রোফাইল স্টোরি করতে তার সম্পর্কে জানার জন্য গবেষণা করবেন কীভাবে? সমস্ত গ্রন্থাগার পুড়িয়ে ফেলবেন? সমস্ত আর্কাইভ পুড়িয়ে ফেলবেন? সমস্ত পত্রিকায় যা ছাপা হয়েছে সেগুলো একে একে খুঁজে বের করে জ্বালিয়ে দেবেন?”
পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপের বিষয়ে জানাতে বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সংবাদ সম্মেলনে প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এ ধরনের অনুরোধ আসার একটি কারণও সংবাদ সম্মেলনে বলেন তৌফিক খালিদী।
“ইন্টারনেটে আছে বলে সহজে পাওয়া যাচ্ছে। সেটা পেলে বিদেশে যাদের সঙ্গে তারা ব্যবসা করতে চান, তারা এগুলো দেখে তাদের সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েন। আমাকে তারা এই যুক্তি দিয়েছে। কিন্তু আমরা তো এই দায় নিতে পারব না। যেটা ইতিহাস, সেটা ইতিহাস। যেটা আর্কাইভে আছে সেটা থাকবে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য থাকবে।”
নিজের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাকে নিয়ে যে অভিযোগ করা হয়েছে, সেটা নিয়ে (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেও) ছাপা হয়েছে। অন্যদের আগে ছাপা হয়েছে। সবার আগে আমাদের এখানে ছাপা হয়েছে। সেটার জন্য আমার সন্তান বিব্রত হয়, আমার আত্মীয় স্বজন বিব্রত হয়। আমি কি সেটা সরিয়ে নিয়েছি? ওটা সারাজীবন থাকবে।”
বাংলাদেশের ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল খেটেছেন, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম মামলা হয়েছে। আর্কাইভ ঘেঁটে সেগুলো নিয়ে গবেষণা করে বই লেখা হচ্ছে। তার সম্পর্কে জানা যাচ্ছে, নতুন প্রজন্ম জানছে।
“কেউ কি বলেছে যে আর্কাইভগুলো থেকে সেগুলো সরিয়ে ফেলা হোক?… কোনটি সত্যি, কোনটি ভিত্তিহীন এগুলো বোঝার ক্ষমতা ছাত্র, গবেষক, শ্রোতা-দর্শক তাদের আছে। সেগুলো থাকবে, সেগুলো নিয়ে গবেষণা হবে।”
প্রধান সম্পাদক বলেন, “অনেক মামলায় তারা কিন্তু ছাড়া পেয়েছেন। নিষ্কৃতি পেয়েছেন। সাজা মওকুফ হয়েছে। সেই সব আদালতের রায়। তাহলে তো আদালতকে আমাদের জিজ্ঞেস করতে হবে- যে আপনারা যেসব আদেশ দেবেন, সেসব আদেশ কি আমরা ছাপতে পারব না? নিউজ করতে পারব না? নাকি পাঁচ বছর পর কেউ আমাদের চাপ দিলে তা তুলে নিতে হবে?”
আদালত যে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, তা কেন ছাপানো যাবে না- সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “২০০৭-০৮ সালে আমাদের ওপর এরকম একটা চাপ ছিল। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ওই ট্রাইব্যুনালে যেতেন, সেখানে যে শুনানি হত, সেই শুনানির আগাম একটা কাগজ সাংবাদিকদের ধরিয়ে দেওয়া হত।
“বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক যা নিজে শুনেছেন, তার ভিত্তিতে খবর তৈরি করতেন। অনেকে সেটা করতেন না। আমরা তাদের ধরিয়ে দেওয়া কাগজ থেকে একটি অক্ষরও ছাপিনি। সেটাই আমাদের অপরাধ।
“হয়ত একটা সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু তার আগেও আমরা সাংবাদিকতা করেছি। ওই ধরনের ধরিয়ে দেওয়া কাগজ থেকে সংবাদ আমরা করিনি। যারা করেছেন তারা বহাল তবিয়তে আছেন, ভালোই আছেন। তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। এগুলো অভ্যাসের ব্যাপার, নীতি নৈতিকতার প্রশ্ন। আমরা কখনও ছাপিনি, কখনও ছাপব না।”