ক্যাটাগরি

স্বাভাবিক হয়েছে চুড়িহাট্টা, হয়নি লিটনদের জীবন

শুধু লিটন নন, দুই বছর আগে চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া প্রায় সবগুলো মানুষ, নিহতের স্বজনদের এখনও দিন কাটে সেই রাতের বিভীষিকা মাথায় নিয়ে।    

শনিবার চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের দুই বছর। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে ছড়িয়ে পড়া সেই আগুন কেড়ে নিয়েছে ৭১ জনের প্রাণ, পোড়া ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন অনেকে।

সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া মুদি দোকানি মো. লিটন আবার সেখানে দোকান সাজিয়ে নিয়ে জীবিকার লড়াইয়ে নেমেছেন।

২০১৯ সালে ভয়ঙ্কর সেই অগ্নিকাণ্ডের পরদিন চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

২০১৯ সালে ভয়ঙ্কর সেই অগ্নিকাণ্ডের পরদিন চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

শনিবার চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের দুই বছর। এ সময়ের মধ্যে নতুন হয়ে উঠেছে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া সেই ওয়াহেদ ম্যানশন। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

শনিবার চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের দুই বছর। এ সময়ের মধ্যে নতুন হয়ে উঠেছে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া সেই ওয়াহেদ ম্যানশন। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

কেমন আছেন জানতে চাইলে বললেন, “ভালো আছি, শুধু রাতে আর ঘুমাতে পারি না। দুই বছর পার হল, কিন্তু ঘুমাতে গেলেই ঘটনাগুলো মাথার মধ্যে বারবার ভেসে আসে। যখন খুব ক্লান্ত হয়ে যাই, তখনই ঘুম আসে।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিটন বললেন, তার ব্যবসাও আর আগের মতো নেই।

“আগুনে যারা মারা গেছেন, তাদের বেশিরভাগ আমার দোকানের খরিদ্দার ছিল। ওয়াহেদ ম্যানশন এখনও চালু হয়নি, মানুষের যাতায়াত কম, বিক্রিও কম।”

ওয়াহেদ ম্যানশনের পশ্চিম পাশের রাস্তার উল্টো দিকে লিটনের দোকান। যখন আগুন লাগে তখন দোকানেই একাই ছিলেন তিনি। আর ছিলেন একজন খরিদ্দার। তাকে মাল দিয়ে টাকা নিয়ে ভাংতিও ফেরত দিয়েছিলেন।

টাকা ক্যাশবাক্সের উপর রাখার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ বিকট শব্দ। দোকানে চকলেটের শোকেস ঝমঝম করে কেঁপে উঠছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি চারদিকে আগুন। সেই সময় দোকানের মায়া ছেড়ে দৌড় না দিলে আজকে …,” গলা বুজে আসে লিটনের।

চুড়িহাট্টার ভয়ঙ্কর সেই রাত। ছবি: রয়টার্স

চুড়িহাট্টার ভয়ঙ্কর সেই রাত। ছবি: রয়টার্স

কী ঘটেছিল?

ওই রাতে চুড়িহাট্টা মোড়ে চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশন নামের একটি ভবন থেকে আগুন লাগার পর খুব দ্রুতই আশপাশের কয়েকটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।

গায়ে গায়ে লেগে থাকা ভবনগুলোতে থাকা রাসায়নিক দ্রব্য, প্লাস্টিক ও পারফিউমের দোকান-গুদাম থাকায় মুহূর্তেই গোটা এলাকা পরিণত হয় অগ্নিকুণ্ডে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকে ছাই হয়ে যান। আগুনের প্রচণ্ডতায় দুমড়ে-মুচড়ে যায় দোকান-পাট, রিকশা-গাড়ি। 

ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, ততক্ষণে শ্মশানে পরিণত হয়েছে চুড়িহাট্টা। ঘটনাস্থল থেকে ৬৭ জনের পোড়া লাশ মর্গে পাঠান উদ্ধারকর্মীরা। পরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ জনে।

শুরুতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও পরে তদন্তে জানা যায়, আগুনের উৎপত্তি হয়েছিল ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে। ওই ভবনে বিভিন্ন দোকানের পাশাপাশি ছিল রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও প্রসাধন সামগ্রীর গুদাম। দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

ওয়াহেদ মঞ্জিলের নিচে রাসায়নিকের বিপুল মজুদ
 

নরককুণ্ডের ক্ষেত্র যেন ‘তৈরি হয়েই ছিল’
 

চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড: ক্যানেস্তারাগুলো কাজ করেছে ‘বোমার মত’
 

চুড়িহাট্টার ছাইভস্মে শোকের মাতম
 

আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল এই ওয়াহেদ ম্যানশন থেকেই

আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল এই ওয়াহেদ ম্যানশন থেকেই

‘ভোলা সম্ভব নয়’

সেই রাতের আগুন কেড়ে নেয় দুই বান্ধবী ফাতেমাতুজ জোহরা বৃষ্টি ও রেহনুমা তারান্নুম দোলাকে। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে চাইল্ড কেয়ার বিভাগের শিক্ষার্থী বৃষ্টি এবং ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের আইনে পড়ুয়া দোলা দুজনেই বাসা পুরান ঢাকাতেই। দুজনের বন্ধুত্ব শৈশব থেকে।

শিল্পকলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন তারা। পরে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের পোড়া দেহের ডিএনএ পরীক্ষায় শনাক্ত হয় দুই বান্ধবীর লাশ।

দোলার বাবা দলিলুর রহমান দুলাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় মেয়েকে এভাবে হারিয়েছি, শত বছরেও ভোলা সম্ভব নয়, একটা সময় চোখের পলক পড়ত না, এখন পলক পড়ছে কিন্তু অন্তরের কষ্ট কোনোভাবেই…।

কলেজেপড়ুয়া দোলার বোন নুশাও এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেন না বোনকে হারানোর সেই স্মৃতি।  আর মা সামছুন্নাহার বলেন, মেয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে ভাড়া বাসাও বদলাননি তারা।

“হাজী রহিম বক্স লেনের বাসায় এখনও থাকছি শুধু মেয়ের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। এই বাসা থেকে ওর চলাফেরা, এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়া আসা যে এখনও অনুভব করি।”

চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নিখোঁজ বৃষ্টি-দোলা
 

প্রিয়জনের শেষ পদচিহ্নে
 

চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনের অংশে ঝুলছে ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ড স্মরণে ব্যানার। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনের অংশে ঝুলছে ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ড স্মরণে ব্যানার। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ফিরে ফিরে আসেন রানা-রাজুর চাচা

বৃদ্ধ বাবা মোহাম্মদ শাহবুল্লাহকে অবসর দিতে ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন দুই ভাই মাসুদ রানা ও মাহবুবুর রহমান রাজু। কিন্তু সেদিনের আগুন কেড়ে নেয় নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর দুই ভাইকে। দুই ছেলেকে হারিয়ে শাহবুল্লাহ এখন মৃত প্রায়।

রানা-রাজুর চাচা মো. রহিম বলেন, “আমাদের বাসা চাঁদনীঘাটের কে বি রুদ্র রোডে। কিন্তু ঘুরেফিরে এই চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনেই আসি। ভাতিজারা তো এখান থেকেই গেল।”

দুই ভাতিজাসহ নিহতদের জন্য শনিবার ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনেই মিলাদ ও দোয়া পড়া হবে বলে জানান তিনি।

এখনও সেই নরককুণ্ড ভোলার চেষ্টায় তারা

চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন এখন যেমন

দুই বছর আগের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের জন্য শুক্রবার জুমার নামাজের পর দোয়া করা হয় চুড়িহাট্টা জামে মসজিদে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

দুই বছর আগের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের জন্য শুক্রবার জুমার নামাজের পর দোয়া করা হয় চুড়িহাট্টা জামে মসজিদে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এখন যেমন চুড়িহাট্টা

দুই বছরে স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছে জনাকীর্ণ ওই মোড়। প্রতিদিন রিকশা-গাড়ি চলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্য, লোকজনের হাঁকডাক সবই চলছে আগের মত।

শুক্রবার সকালে ওয়াহেদ ম্যানশনের উল্টোদিকের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে দেখা গেল মাছ কেনাবেচা চলছে হরদম।

সুজন নামে স্থানীয় একজন বাসিন্দা বললেন, “চুড়িহাট্টা আগের মতই হয়ে গেছে আবার। ওয়াহেদ ম্যানশন নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে। নিচের দোকানগুলো যে কোনো সময় খুলে যাবে।”

রাস্তার উত্তর পাশের পুরনো ভবন ভেঙে নতুন করে তৈরি হচ্ছে। নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে পুড়ে যাওয়া দুটি ভবন।

ওয়াহেদ ম্যানশনের পূর্ব পাশের রাজ মহল হোটেলেও ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেল। একজন ক্রেতা জানালেন, খাবার ভালো বলে ভিড়ও বেশি হয় সেখানে।

দুই বছর আগের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা তুলতেই বললেন, “যাদের আপন মানুষ মারা গেছে, তারা তো মনে ….। সাধারণ মানুষের মনে তেমনভাবে আর নেই।”

দুপুরেও চুড়িহাট্টা মোড়ে কয়েকটি ভ্যানে সবজি ও ফল বিক্রি হতে দেখা গেল। সন্ধ্যায় সেখানে আরও কিছু ভ্যান এসে জড়ো হয়। ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে শ্রমিকদের উপস্থিতি দেখা গেল বেশ।

চকবাজার থানার পরিদর্শক তদন্ত মো. কবির হোসেন হাওলাদার জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া শিগগিরই। কিছু পরীক্ষার প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি. তাই প্রতিবেদন দিতে দেরি হচ্ছে।