ভাড়াটিয়ার অভাবে কারও
কারও আবার দ্বিতীয় মাসের মতো ফ্ল্যাটা-অ্যাপার্টমেন্ট খালি পড়ে থাকছে। একে তো ভাড়ার
টাকা পাচ্ছেন না, তারপরে ওই সব ফ্ল্যাটের পানি-বিদ্যুতের বিল পকেট থেকে দিতে হবে বলে
আক্ষেপ করছেন তারা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর
কাকরাইল, বিজয়নগর, সার্কিট হাউজ রোড, মালিবাগ, ফকিরাপুল, নয়া পল্টন লেন, রামপুরা, বনশ্রীর
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
দুই মাস আগেও যেদিন
মালিকরা বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপন ঝুলিয়েছেন, তার এক সপ্তাহের মধ্যেই ভাড়া ঠিক হয়ে গেছে,
সেখানে এখন পুরো মাস টু-লেট, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেও ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না বলে জানালেন
তারা।
ফরিদ আহমেদ ও আদিলুর
রহমার বনশ্রীর দুটি বাসার মালিক। গত মাসে ‘টু-লেট’ দিয়েও এখনও ভাড়াটিয়া পাননি তারা।
ফরিদ আহমেদ বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসে ভাড়াটিয়ার আকাল পড়েছে। মার্চ-এপ্রিল দুই মাস
বাসার দুইটা ফ্লোর খালি পড়ে আছে, ভাড়াটিয়া পাচ্ছি না। কী করব বলেন?”
আদিলুর রহমানও বলেন,
“বাসা-বাড়ির মালিক হলে অনেকে মনে করেন বড়লোক হয়ে গেছি। এই দেখেন না এপ্রিল মাসে ভাড়াটিয়া
নেই। কিন্তু তাই বলে কি গ্যাসের বিল, পানির বিল মাফ হয়ে যাবে? না হবে না। এই বিল আমাকে
দিতে হবে।
“আগামী মাসেও ভাড়াটিয়া
পাব কি না আল্লাহ মালুম। বাসার মালিক হওয়া যেমন ভাগ্যের তেমনি ভোগান্তি পোহাতে হয় অনেক,
যে মালিক সে-ই কেবল তা বোঝে।”
ভাড়াটিয়া সংকট প্রকট
আকার নিয়েছে ফকিরাপুল-আরামবাগ এলাকায়। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও সচিবালয়ের কাছাকাছি
বলে এই এলাকায় বাসা ভাড়ার চাহিদা বেশি, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের বসবাসও বেশি। এই এলাকায়
রয়েছে বহু ব্যাচেলর মেস।
ফকিরাপুলের গরম পানির
গলি, করীম মেস এ রকম কয়েকটি জায়গা আছে যেখানে প্রতি মাসেই ভাড়াটিয়া বদল হয়, নতুন ভাড়াটিয়া
আসে।
ঘনবসতিপূর্ণ ফকিরাপুলের
এক বাসা থেকে আরেক বাসার জানালা এতো কাছাকাছি যে, উঁকি মারলে পরস্পরকে খুব কাছাকাছি
মনে হয়। এখানকার দেওয়ালে দেওয়ালে ‘টু-লেট’ এর অনেক কাগজ ঝুলে থাকতে দেখা গেছে।
সরু অলি-গলির দেওয়ালে
দেওয়ালে টাঙানো এসব বাসা বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে এ রকম ভাষায়: ‘রুম ভাড়া হবে- পহেলা এপ্রিল
থেকে মেস অথবা ফ্যামিলির জন্য একটি রুম। ওয়াই-ফাইয়ের সু-ব্যবস্থা আছে’ অথবা ‘ব্যাচেলর-চাকুরিজীবী
আবশ্যক, ভিআইপি ফ্ল্যাটে দুই রুম ভাড়া হবে, এটাচ বাথ ও একটি বারান্দা আছে, ২৪ ঘণ্টা
পানি থাকে’ ইত্যাদি।
ফকিরাপুলের একটি মেসের
বাসিন্দা বেসরকারি একটি ফার্মের কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন বলেন, “এই চারতলা ভবনে প্রায়
৪৫টি রুম আছে। কিছু ফ্যামিলি আর অন্যগুলো মেস। এই বাড়িতেও মেস ভাড়ার সাতটি বিজ্ঞপ্তি
ঝুলছে গতমাস থেকেই। কিন্তু এবার ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না।
“করোনাভাইরাসের সংক্রমণে
ব্যাচেলররা অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। আমারও যাওয়ার কথা ছিল। যেতে পারি নাই বলে আটকে গেছি।
এখানকার প্রায় মেসই এখন বন্ধ। কারণ মেসে যে কাজের মহিলারা থাকেন তারাও বাড়ি চলে গেছেন।”
ফকিরাপুলের গরম পানি
গলিতে অনেক মেসে ব্যাচেলরদের বসবাস। ২০ দিন আগেও এই গলিতে রাত নেই, দিন নেই মানুষের
আনাগোনা ছিলো সারাক্ষণ। বৃহস্পতিবার সেই গলিতে গিয়ে দেখা গেল মানুষের পদচারণা নেই,
একেবারেই জনশূন্য গলি।
ফকিরাপুলের পুরানো
বাসিন্দা আলিম মিয়া বলেন, “যে গজব পড়ছে ভাই, বাড়িওয়ালাদের মাথায় ঠাডা পড়েছে। এই গলিতে
এখন মানুষ খুঁইজা পাইবেন না। সকলেই বাড়ি চইলা গেছে।”
রামপুরা, বাড্ডা, মালিবাগ,
শান্তিবাগ প্রভৃতি জায়গায়ও বাড়ি ভাড়ার ‘টু-লেট’ ঝুলে আছে। শান্তিবাগ মোড়ে ঢুকতে হাতের
দুই দিকে বাসা ভাড়ার অসংখ্য বিজ্ঞাপন দেওয়ালে ঝুলনো। প্রতিদিন বাড়ি কিংবা রুম খুঁজতে
এখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। কিন্তু গত ২৪ মার্চ থেকে এখন আর সেভাবে বিজ্ঞাপন দেখার
মানুষ আসে না বলে জানালেন হুইল চেয়ারে বসা ভিক্ষুক আমিনউদ্দিন।
“এখন বাড়ি ভাড়ার মানুষজন
সেভাবে এখানে দেখি না। গত কয়েক দিনে একজন মানুষকে দেখিনি দেওয়ালের লেখা পড়তে। আমি সকাল
১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এখানে ভিক্ষা করি।যে যা দেয় তা নিয়ে আমার জীবন চলে। কিন্তু
মানুষজন কমে যাওয়ায় আমারও খোরাকি যোগাড় করতে কষ্ট হচ্ছে।”
মঙ্গলবার পহেলা এপ্রিল
ছিল ঢাকায় বাসা বদলের দিন। ঢাকার বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া শেষ দিন পর্যন্ত থেকে নতুন মাসের
প্রথম দিন নতুন বাসায় উঠেন।
রাজারবাগের একটি গলিতে
সকালে ছোট পিকআপে করে জিনিসপত্র এনে নতুন বাসায় উঠেছেন ব্যাংককর্মী আবদুস শুকুর।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমকে বলেন, “শান্তিবাগে এক বাসায় থাকতাম। পানির সমসা, সেজন্য পাল্টেছি। গতকালই আসার
কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন শান্তিবাগের বাসায় ছিলাম বলে মালিক বললেন, বাসা তো ভাড়া হয়নি-
আপনি ধীরে সুস্থে যান।
“সেজন্য ২ তারিখ বাসা
পাল্টে নতুন বাসায় উঠেছি। তবে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে মালামাল স্থানান্তর করতে গিয়ে।
কারণ কোনো যানবাহন পাওয়া যাচ্ছিল না। ঠেলাগাড়ি যাদের সাথে যোগাযোগ করেছি তারা গ্রামের
বাড়িতে চলে গেছে। এই দুঃসময়ে বাসাবাড়ি পাল্টানো কঠিন কাজ।”
তিনি বলেন, “আপনি শহর
ঘুরে থাকলে দেখবেন, গতকাল বাসা-বাড়ির মালামাল নিয়ে কোনো ঠেলাগাড়ি কিংবা অন্য কোনো যানবাহন
আপনার চোখে পড়েছে বলে আমার মনে হয় না। অথচ তিন মাস আগে মাসের প্রথম দিন বাসা পাল্টানোর
মালামালের ঠেলাগাড়ি অনেকেরেই চোখে পড়েছে।”
শান্তিনগরের কাছে সার্কিট
হাউজ রোডে এবং কাকরাইলের কাছে বেশ কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখা গেছে, ফটকে টু-লেট
লাগানো। সার্কিট হাউজ সড়কের একটি অ্যাপার্টেমেন্টের দারোয়ান আরমান জানালেন, গত মাস
থেকে এখানে দুটি টু-লেট ঝুলছে, কিন্তু ভাড়াটিয়া আসছে না।
গত দুই মাসে কি কোনো
ভাড়াটিয়া যোগাযোগ করেনি প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “একজন একটি অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে
এসেছিলেন। পরে জানাবেন বলেছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কিছু আর জানাননি।”
কাকরাইলের একটি অ্যাপার্টমেন্টে
চারটি টু-লেট ঝুলছে মার্চের শুরু থেকে। এপ্রিল মাসেও ভাড়াটিয়া পাওয়া যায়নি বলে জানালেন
মালিক আফতাব আহমেদ।
পেশায় ব্যবসায়ী আফতাব
বলেন, “এখানে আমার দুটি অ্যাপার্টমেন্ট। একটিতে থাকি, অন্যটি ভাড়া দেই। দেশে এখন ক্রান্তিকাল
চলছে। জীবন বাঁচানোই মানুষের প্রধান লক্ষ্য। সেজন্য দেখবেন ভাড়াটিয়ার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
“পরিস্থিতি না পাল্টানো
পর্যন্ত অপেক্ষা তো করতেই হবে। মালিক হিসেবে ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কিছু করার নেই।”
মালিবাগের গুলবাগে
গত মাস থেকে বাসা ভাড়ার টু-লেট ঝুলিয়েও ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না মনোয়ার আহমেদ।
তিনি বলেন, “কী করুম
ভাই, আমার বাসা তো খালি থাকে না। এখানে ১০টা রুম আছে। ভাড়া দেই। এখন দুইটা খালি পড়ে
আছে। এই মাস তো শুরু হয়ে গেল। দেখা যাক আগামী মাসে পাওয়া যায় কি না।”