বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডও বহাল রাখা হয়েছে। এ টাকা পরিশোধ না করলে তাকে আরও এক বছর কারাভোগ করতে হবে।
এ মামলা সংক্রান্ত জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।
তবে সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে বিচারিক আদালত হাজী সেলিমকে যে তিন বছরের যে কারাদণ্ড দিয়েছিল, দুর্নীতি দমন কমিশন সেই অভিযোগ ‘প্রমাণ করতে না পারায়’ উচ্চ আদালত সে অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছে।
রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে পুরান ঢাকার এই আওয়ামী লীগ নেতাকে বিশেষ জজ আদালত-৭ এ আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে।
এই সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে তার জামিননামা বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করে।
আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ায় এ মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে দণ্ডিত হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা বেগমের আপিলটি বাতিল করা হয়েছে।
জ্ঞাত আয় সম্পদ অর্জনের দায়ে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় গুলশান আরা বেগমকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল বিচারিক আদালত।
হাই কোর্ট রায়ে বলেছে, বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হাজী মোহাম্মদ সেলিমের আপিল সংশোধন করে (আংশিক গ্রহণ ও আংশিক খারিজ) দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ধারা সংক্রান্ত আপিল গ্রহণ করা হল। আর এই আইনের ২৭ (১) এ আপিলের অংশ খারিজ করা হল।
আদালতে হাজী সেলিম ও তার স্ত্রীর আপিলের পক্ষে শুনানি করেন আব্দুল বাসেত মজুমদার ও আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান মনির ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তামান্না ফেরদৌস।
ফৌজদারি মামলায় এই দণ্ডের কারণে হাজী সেলিমের সংসদ সদস্যপদও এখন ঝুঁকিতে পড়ল।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো আইনপ্রণেতা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই কিংবা ততোধিক বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবে না এবং মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি আর সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন না।
তবে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা মনে করেন, সর্বোচ্চ আদালতে এ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাজী সেলিমের সংসদ সদস্য পদ ‘থাকবে’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, হাই কোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন।
“সম্পদের উৎসের বিষয়ে বিচারিক আদালতের রায়ে যে সাজা দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু উৎস থেকে যে সম্পদ অর্জিত হয়েছিল, সে সম্পদের কারণে তার সাজা বহাল রাখা হল। মূলত এই গ্রাউন্ডেই এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।”
এ আইনজীবী বলেন, এ মামলাটি ‘একেবারে ব্যতিক্রমী’ একটি মামলা। ২০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য একদিনে নেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালের ২২ মে এ মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর ২৭ মে রায় হয়।
“অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার ৫ দিনের মধ্যে একটি মামলার বিচারকাজ কীভাবে শেষ হয়! এই বিষয়গুলো উচ্চ আদালত বিবেচনায় নেননি। ফলে আমরা আপিল করব।”
অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, “হাই কোর্ট রায়ে হাজী সেলিমের ১০ বছরের সাজা বহাল রেখেছেন। আমি মনে করি এটি তার নৈতিক স্খলন। তিনি সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন স্পিকার। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে রায়ের অনুলিপি পৌঁছে দেবে।”
এ আইনজীবী বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২৭(১) ধারা জ্ঞাত আয় সম্পদ অর্জনের জন্য বিচারিক আদালত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তি যে সাজা দিয়েছে, তা ‘যথাযথ, আইনসঙ্গতভাবেই’ দিয়েছে বলে হাই কোর্ট রায়ে বলেছে।
আর সম্পদের তথ্য গোপন সংক্রান্ত ২৬(২) ধারার যে অভিযোগে হাজী সেলিমকে ৩ বছরের সাজা দিয়েছিল বিচারিক আদালত, সেটি থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
“বিষয়টি আমি কমিশনকে লিখিতভাবে জানাব। কী হবে না হবে, তা কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।”
হাজী সেলিমের যে সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ এসেছে হাই কোর্টের রায়ে, তার আর্থিক মূল্য ২৬ কোটি টাকার বেশি বলে জানান দুদকের আইনজীবী খুরশীদ।
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক।
২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল বিশেষ আদালতের রায়ে তাকে মোট ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আর জ্ঞাত আয় সম্পদ অর্জনে ‘সহযোগিতার’ দায়ে হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা বেগমকে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরে ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর হাজী সেলিম ও তার স্ত্রী গুলশান আরা বেগম এ রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করেন। ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাই কোর্ট ১৩ বছরের সাজা বাতিল করে রায় দেয়।
হাই কোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে দুদক। ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি হাই কোর্টের রায় বাতিল হয়ে যায়।
সেই সঙ্গে হাজী সেলিমের আপিল পুনরায় হাই কোর্টে শুনানির নির্দেশ দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
সে নির্দেশনার আলোকে গত বছর ৯ নভেম্বর দুদক হাজী সেলিমের আপিল দ্রুত শুনানির জন্য আবেদন করে।
সে আবেদনের শুনানি করে আদালত ১১ নভেম্বর এ মামলার বিচারিক আদালতের নথি তলব করে। নথি আসার পর গত ৩১ জানুয়ারি আপিলের শুনানি শুরুর পর মঙ্গলবার রায় হল।
পুরনো খবর
হাজী সেলিমের দণ্ড বহাল থাকবে কি না, জানা যাবে ৯ মার্চ
হাজী সেলিমের পুরনো মামলার নথি তলব হাই কোর্টের
হাজী সেলিমকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে রেখে আ. লীগের ঢাকা দক্ষিণের কমিটি
নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারপিটের মামলায় ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র