ত্রাণসামগ্রীর আশায় চট্টগ্রামের রাস্তায় ভিড় করছে ছিন্নমূল অসহায় মানুষ। ছবিটি গতকাল বন্দর এলাকার —মোস্তাফিজুর রহমান
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে উদভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সারাদেশে দুস্থ ও হতদরিদ্রদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রকৃত দুস্থ মানুষের সংখ্যা এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দের পরিমাণ অপ্রতুল।
কোনো কোনো ইউনিয়নে যেখানে কয়েক হাজার দুস্থ মানুষ রয়েছেন, সেখানে বরাদ্দকৃত খাদ্যসামগ্রী বণ্টন করা সম্ভব হচ্ছে মাত্র এক থেকে দেড়শ জনকে। অবশিষ্ট বৃহত্ সংখ্যার দুস্থ মানুষ থেকে যাচ্ছেন ত্রাণের বাইরে।
ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্তরা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ খুবই সামান্য হওয়ায় একদিকে যেমন প্রাপ্ত খাদ্যসামগ্রী বণ্টনের ক্ষেত্রে ‘কাকে রেখে কাকে দেব’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে বদনামও নিতে হচ্ছে। বরাদ্দের সঙ্গে চাহিদার সামঞ্জস্য না থাকায় যারা ত্রাণ পাচ্ছেন না তারা এক ধরনের সন্দেহের চোখে দেখছেন জনপ্রতিনিধিদের। চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে বরাদ্দ না দেওয়ায় ত্রাণপ্রত্যাশীদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝিরও ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে।
বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রান্তিক পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) ও চেয়ারম্যানের মাধ্যমে দুস্থদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সেই তালিকা তৈরির ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা। মেম্বার-চেয়ারম্যানদের বেশিরভাগই সাধারণত রাজনৈতিক বিবেচনায় ও নিজস্ব সম্পর্কের ভিত্তিতে তালিকা করছেন। এর ফলে প্রকৃত দুস্থদের অনেকে তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। আবার ‘দুস্থ’ কিংবা ‘হতদরদ্রি’ কে বা কারা সেটিও সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নেই। ফলে তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে মূলত প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি।
এতে এমনও ঘটনা ঘটছে, একই ব্যক্তি একাধিকবার কিংবা প্রয়োজন না থাকলেও ত্রাণ পাচ্ছেন। আবার প্রকৃথঅর্থেই অসহায় হয়েও একবারও সরকারি ত্রাণ পাচ্ছেন না অনেকে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মতে, দুস্থ মানুষের তালিকা প্রণয়ন এবং চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দের পুরো প্রক্রিয়াটিই কার্যত অপরিকল্পিত। যার কারণে একদিকে, ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে অযৌক্তিকভাবেই বদনামের কবলে পড়তে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। অন্যদিকে, সরকারের বরাদ্দেরও অপচয় হচ্ছে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি বা জাইকার সামপ্রতিক গবেষণা প্রকল্প ‘এম্পেরিকাল স্টাডিজ অন রিস্ক অ্যান্ড প্রোভার্টি ইন বাংলাদেশ’- এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এখনও অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্র্য বিমোচণ ও মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ করার লক্ষ্যেই মূলত ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজন পড়ে। ‘প্রোভার্টি নেটে’র ছিদ্রসমূহ বন্ধের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত ত্রাণ কার্যক্রম অপরিহার্য।
যদিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার থেকে দেশের প্রতিটি জেলায় পর্যাপ্ত চাল ও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কোথাও খাদ্যের কোনো সমস্যা হবে না। যেখানে যতটুকু চাহিদা থাকবে ততটুকুই সরবরাহের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দুস্থদের তালিকা প্রণয়নের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী জানান, কারা এই সহায়তা পাবেন- সেই তালিকা চূড়ান্ত করছেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। ওয়ার্ড পর্যায় থেকে ইউনিয়ন ও উপজেলা হয়ে ডিসি কার্যালয়ে সেই তালিকা যায়। সেক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা এই তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
করোনা পরিস্থিতিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি জেলায় ইতোমধ্যে ২০০ থেকে ৫০০ টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা। জেলাগুলোর আয়তন ও জনসংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে ওই সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রথম ধাপে ১ লাখ ১০ হাজার খাবারের প্যাকেট তৈরি করা হয়। তাতে ১০ কেজি চাল, ৫ কেজি আটা, ২ কেজি লবণ, ১ কেজি চিনি, ১ লিটার তেল ও নুডলস দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী এসব খাবারের প্যাকেট জেলাগুলোতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, যা ইতোমধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে।
ত্রাণ কার্য (চাল) এবং ত্রাণ কার্য (নগদ) বরাদ্দ সম্পর্কিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গতকাল বৃহস্পতিবারের এক অফিস আদেশপত্রে দেখা যায়, মহানগরীসহ দেশের ৬৪টি জেলাকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে।
যার মধ্যে রয়েছে- বিশেষ শ্রেণী এবং ‘এ’ ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরি। বিশেষ ক্যাটাগরির মধ্যে রয়েছে- মহানগরীসহ ঢাকা জেলা, মহানগরীসহ গাজীপুর জেলা, মহানগরীসহ ময়মনসিংহ জেলা, মহানগরীসহ চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরীসহ খুলনা জেলা।
মন্ত্রণালয়ের গতকালের হিসাব অনুযায়ী, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৬৪টি জেলায় গতকাল ত্রাণকার্যে বিশেষ বরাদ্দ হিসেবে চাল দেওয়া হয়েছে ৮হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন। আর ৬৪ জেলায় গতকাল নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর ৩০ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে ত্রাণ হিসেবে চাল দেওয়া হয়েছে ৩৯ হাজার ৬৬৭ মেট্রিক টন, এই সময়ে সারাদেশে নগদ অর্থ দেওয়া হয় ১১ কোটি ২৪ লাখ ৭২ হাজার ২৬৪ টাকা।
করোনা ইস্যুতে ত্রাণ বিতরণে মোট বরাদ্দের বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামাল গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘ওইভাবে কোনো সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করা হয়নি। আমাদের যে বাজেট রয়েছে আমরা এখন সেখান থেকে খরচ করছি। সময়ে-সময়ে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বরাদ্দ চাচ্ছি, অর্থ মন্ত্রণালয় সেভাবে টাকা ছাড় করছে।’
সিনিয়র সচিব বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কতদিন চলবে সেবিষয়ে জ্ঞাত কোনো তথ্য না জানার কারণে আমরা মাসওয়ারি পরিকল্পনা নিচ্ছি। মার্চ মাসের জন্য এক ধরনের পরিকল্পনা ছিল, এপ্রিলের জন্য আরেক ধরনের পরিকল্পনা। আপাতত আমরা জুন পর্যন্ত পরিকল্পনা করে রেখেছি। আবার ডিসেম্বর পর্যন্তও পরিকল্পনার চিন্তা রয়েছে।’
দুস্থ কারা, কিসের ভিত্তিতে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে- এব্যাপারে জানতে চাইলে শাহ কামাল বলেন, আমাদের কাছে দারিদ্র্যের হার রয়েছে, কর্মজীবি মানুষের হিসাব রয়েছে, এলাকা ভিত্তিক জনসংখ্যার চিত্র আছে, দিনমজুরের একটা হিসাবও আছে। কার্যত এগুলোর ওপর ভিত্তি করেই জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি কাজ করছে।’
মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এই ব্যাখ্যা দিলেও বাস্তবে ত্রাণ বিতরণের পুরো প্রক্রিয়াটিকেই ‘অপরিকল্পিত’ কিংবা ‘বাস্তব সম্মত নয়’ বলে অভিহিত করেছেন জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ।
তাদের মতে, একটি উপজেলায় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাতে ভাগ করলে একটি ইউনিয়নের ভাগে পড়ে দেড় টনের মতো। এই দেড় টন দিয়ে বড়ো জোর দেড়শ মানুষকে ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু যেই ইউনিয়নে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ, সেখানে গড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার দরিদ্র মানুষ রয়েছেন। বাস্তবে মাত্র দেড়শ জনের মতো ছাড়া বাকিরা সবাই সরকারি ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা সন্দেহ করছেন জনপ্রতিনিধিদের। অন্যায়ভাবেই জনপ্রতিনিধিদের এই বদনামের ভাগিদার হতে হচ্ছে।
ইত্তেফাক/জেডএইচ