ক্যাটাগরি

কার্টুনিস্ট কিশোরের ডান কানে অস্ত্রোপচার

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় নয় মাস কারাগারে থাকার পর সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পাওয়া কিশোরের অভিযোগ, গত বছর মে মাসে থানায় গ্রেপ্তার দেখানোর আগে ‘বাসা থেকে তুলে নিয়ে তার ওপর নির্যাতন’ চালানো হয়। তখনই তার কানে ওই ক্ষত তৈরি হয়।

ওই ঘটনায় ‘হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ’ আইনে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলার আবেদনও করেছেন এই কার্টুনিস্ট।

আহসান কবীর জানান, শনিবার দুপুরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে কিশোরের কানে অস্ত্রোপচার করা হয়।

“কিশোরের ডান কানে টিমপ্যানিক মেমব্রেন রিপেয়ার মিরিংগোপ্লাসটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি যন্ত্র বসানো হয়েছে। এটা ছয় মাস পর্যবেক্ষণ করা হবে। পরবর্তী অবস্থা দেখে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেবেন।”

কিশোরের ডায়াবেটিস এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে, এখন তিনি আগের চেয়ে ভালো আছেন বলে জানান আহসান কবীর।

গত ৪ মার্চ জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর ১০ মার্চ আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে ‘হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ’ আইনে ওই মামলা করেন কিশোর।

তার আরজিতে বলা হয়, গত বছরের ৫ মে রমনা থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কিন্তু তারও তিন দিন আগে ২ মে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে সাধারণ পোশাকের ১৬-১৭ জন লোক কাকরাইলের বাসা থেকে তাকে ‘জোর করে হাতকড়া ও মুখে মুখোশ পরিয়ে অজ্ঞাত এক নির্জন জায়গায়’ নিয়ে যায়।

সেখানে ২ মে থেকে ৪ মে তার ওপর ‘শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার’ চালানো হয় বলে অভিযোগ করে কিশোর বলেছেন, তার কানে ‘প্রচণ্ড জোরে থাপ্পর মারা হয়’, কিছু সময়ের জন্য বোধশক্তিহীন হয়ে পড়েন তিনি। পরে তিনি বুঝতে পারেন, কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ‘স্টিলের পাত বসানো’ লাঠি দিয়ে তাকে ‘পেটানো’ হয়। যন্ত্রণা ও ব্যথায় তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন।

আর্জিতে তিনি বলেছেন, পরে তিনি নিজেকে র‌্যাব কার্যালয়ে দেখতে পান। সেখানে তার সঙ্গে লেখক মুশতাক আহমেদের দেখা হয়। মুশতাকের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারেন, মুশতাককে ‘বৈদ্যুতিক শক’ দেওয়া হয়ছে।

৬ মে রমনা থানায় হস্তান্তর করার পর ‘সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয় তাদের বিরুদ্ধে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার এসআই জামশেদুল ইসলাম তখন বলেছিলেন, কার্টুনিস্ট কিশোর তার ‘আমি কিশোর’ নামের ফেইসবুক একাউন্টে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামূলক কার্টুন-পোস্টার পোস্ট করতেন। আর মুশতাক তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে কিশোরের সেসব পোস্টের কয়েকটি শেয়ার করেন।

র‌্যাব-৩ এর ডিএডি আবু বকর সিদ্দিকের করা ওই মামলায় রাষ্ট্রচিন্তার সংগঠন দিদারুল ভূইয়া এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নানকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে এ দুজন জামিনে মুক্তি পান। মুশতাক ও কিশোরের পক্ষে বেশ কয়েকবার জামিনের আবেদন হলেও তা আদালতে নামঞ্জুর হয়।

এই মামলায় আসামির তালিকায় মুশতাক, কিশোর, দিদার, মিনহাজের সঙ্গে আরও ছিলেন নেত্র নিউজের সম্পাদক সুইডেন প্রবাসী তাসনিম খলিল, জার্মানিতে থাকা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক শাহেদ আলম, হাঙ্গেরি প্রবাসী জুলকারনাইন সায়ের খান (আল জাজিরার প্রতিবেদনের স্যামি), আশিক ইমরান, স্বপন ওয়াহিদ ও ফিলিপ শুমাখার।

তবে তদন্তের পর শুধু মুশতাক, কিশোর ও দিদারকে আসামি করে গত জানুয়ারিতে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় রমনা থানা পুলিশ। বাকি আট আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেন এ মামলায় অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।

সেই দায়িত্ব পাওয়ার পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উপপরিদর্শক ও মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আফছর আহমেদ আসামি কিশোর ও মুশতাককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছিলেন।

কিন্তু সেই শুনানি হওয়ার আগেই ২৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুশতাকের মৃত্যু হয়। আর হাই কোর্ট থেকে গত ৩ মার্চ ছয় মাসের জামিন পাওয়া কিশোর পরদিন কারামুক্ত হন।   

মুশতাকের মৃত্যুতে প্রতিবাদ শুরু হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি নতুন করে জোরালো হয়ে ওঠে। কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন’ হিসেবে বর্ণনা করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পরপরই একটি হাসপাতালে ভর্তি হন কিশোর। তার ভাই সে সময় বলেছিলেন, কিশোর শরীরিকভাবে অসুস্থ, কান দিয়ে পুঁজ পড়ে, ঠিকমত হাঁটতে পারেন না। হঠাৎ করে পড়ে যান, শরীরে নানা রকম রোগের উপসর্গও দেখা যাচ্ছে।