সোমবার এক আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের
সূচনালগ্নে কূটনীতিক হিসাবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে একথা বলেন তিনি।
বান কি মুন বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব ও
উত্তরাধিকার বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে বিশ্বব্যাপী অন্য উপনিবেশবাদবিরোধী
ও স্বাধীনতা সংগ্রামকেও।
বঙ্গবন্ধুর সমন্বিত কূটনীতি স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের শিল্পায়নসহ
সার্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষকে অতি দারিদ্র্য থেকে তুলে এনেছে
বলেও মন্তব্য করেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত
বঙ্গবন্ধু লেকচার সিরিজের চতুর্থ পর্ব ‘বঙ্গবন্ধু: বাংলাদেশের চেতনা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ
উপস্থাপন করেন বান কি মুন।
একাত্তরে বাংলাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধ করছে, তখন দিল্লীতে দক্ষিণ
কোরিয়া দূতাবাসে অধঃস্তন কূটনীতিক ছিলেন জাতিসংঘের অষ্টম মহাসচিব বান কি মুন। ১৯৭৩
সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তির প্রতিনিধিদলের
সদস্য ছিলেন তিনি।
বান কি মুনের কলম দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত
ওই চুক্তিতে সই করেছিলেন জানিয়ে সোমবার তিনি বলেন, “এখনও সেই কলম আমি নিজস্ব স্যুভেনির
হিসাবে সংরক্ষণ করেছি। এটা আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি।”
সেই সফরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাতের
স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, ওই কর্মকর্তার নম্বর ফোন নম্বর চাইলে এক পাতা কাগজের কোণে
নম্বরটি লিখে তা ছিঁড়ে তার হাতে দেন।
‘মিতব্যয়িতার’ ওই ঘটনা তাকে অভিভূত করে উল্লেখ করে মুন বলেন,
বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা কীভাবে তাদের কাজ, জীবন ও সম্পদ রক্ষায় মিতব্যয়ী ছিলেন
তা আজও সুস্পষ্ট মনে পড়ে। একখণ্ড কাগজও তারা বাঁচাতে চাইতেন।
‘সম্পদ বাঁচানোর’ এই মানসিকতাও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে
বড় ভূমিকা রেখেছে বলে তিনি মনে করেন।
বান কি মুন বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শুধু যে বাংলাদেশের
জনক হিসেবে নয়, বিশ্বনেতা হিসেবেও আজীবন স্মরণ করা হবে, অধঃস্তন একজন কূটনীতিক হিসেবে
সেই সময়ে সেটা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
”বঙ্গবন্ধু এমন একজন দূরদর্শী ব্যক্তি ও বিরল নেতা, সদ্য জন্ম
নেওয়া বাংলাদেশের উন্নতিই ছিল অভীষ্ট। মানবাধিকার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা এবং পরিবেশের
ক্ষেত্রে তিনি সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন।”
তিনি বলেন, ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য দেশের
মানুষকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ‘চ্যাম্পিয়ন’ ছিলেন তিনি। মানবাধিকারের জন্য তার অঙ্গীকার
বিশ্বের অন্য প্রান্তের নিপীড়িত মানুষের জন্যও ছড়িয়ে পড়েছিল।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে ভর করে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা তুলে ধরতে গিয়ে সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি
প্রতিবেদেনে বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বান কি মুন।
সেখান থেকে দারিদ্র্য বিমোচন, নারী শিক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ
অন্য কয়েকটি খাতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা তুলে ধরেন তিনি।
অর্থনীতির উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের
অর্জনের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ”শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক
জলবায়ু অভিযোজনে তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়ায় বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে
রয়েছে।
“এটা সবসময় আমার কাছে অভিভূত হওয়ার মত ব্যাপার; যখন জাতিসংঘ
মহাসচিব ছিলাম তখনও, এখনও। জলবায়ু অভিযোজনে বাংলাদেশ উদাহরণ, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগে
প্রাণহানি কমানোর ক্ষেত্রে। যা সম্ভব হয়েছে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত আশ্রয়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধ
নির্মাণের মাধ্যমে।”
এক্ষেত্রে ১৯৭০ সালে তিন লাখ লোকের মৃত্যুর বিপরীতে ঘূর্ণিঝড়
আম্ফানের সময় মাত্র শখানেক মানুষের মৃত্যুর কথা তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা বহুমুখী সমস্যা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে
রয়েছি। কোভিড-১৯ ও অন্যান্য বৈশ্বিক সমস্যা সব দেশের মানুষ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হওয়ার
দিক উন্মোচন করেছে। এটা স্পষ্ট করেছে, দারিদ্র্য ও বৈষম্যরোধে এবং জলবায়ু মোকাবেলায়
বিশ্ব নেতাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
“আমি বিশ্বাস করি, জরুরি এই সময়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত বঙ্গবন্ধুর
মত নেতাদের স্বপ্ন ও উত্তরাধিকারকে কাজে লাগানো।”
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই আয়োজনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রাচার প্রধান আমানুল হকের সঞ্চালনায় এ সময়
অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন,
ঢাকায় কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি জ্যাং কেয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা
ইসলাম বক্তব্য দেন।