তাদের ভাষ্য, আগুন লাগার পর আইসিইউ থেকে রোগীদের ‘দ্রুত না সরানোয় ধোঁয়ার মধ্যে দমবন্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে’। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ওই রোগীদের অবস্থা এমনিতেই ‘ক্রিটিক্যাল’ ছিল। তবে দমবন্ধ হয়ে তাদের মরার কারণ নেই, তারা ভেন্টিলেটরে ছিলেন।
বুধবার সকাল ৮টার দিকে হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় কোভিড ওয়ার্ডের আইসিইউতে লাগা আগুন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা বেলা সাড়ে ৯টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আনেন।
ওই ওয়ার্ডের ১৪টি আইসিইউ কক্ষে ১৪ জন রোগী ছিলেন; আগুন লাগার পর তাদের পুরাতন ভবনের আইসিইউ ও বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু স্থানান্তরের পর কাজী গোলাম মোস্তফা (৬৬), আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৮) ও কিশোর চন্দ্র রায় (৭০) নামের তিনজনের মৃত্যু হয়।
গোলাম মোস্তফার মেয়ে রাবেয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগুন লাগার পর আমাদের ভেতর থেকে বের করে দিল। যদি যথাসময়ে বের করতে পারতাম, তাহলে বাবাকে এভাবে মরতে হত না।”
উত্তরার কেসি হাসপাতাল থেকে বৃহস্পতিবার তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয় জানিয়ে রাবেয়া বলেন, “মঙ্গলবার বাবার অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছিল। শুধু কর্তৃপক্ষের অবহেলায় বাবা মারা গেলেন।”
আর মোস্তফার শ্যালক আরিফুজ্জামান বলেন, “দুলাভাই মারা গেছেন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে।”
অভিযোগের বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নাজমুল হক বলেন, আগুন লাগার ১৫ মিনিটের মধ্যে তিনি সেখানে পৌঁছে যান। অগ্নিকাণ্ডের পর তিনি নিজেই আইসিইউর রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন।
“সবাই ক্রিটিক্যাল অবস্থায় ছিলেন। অক্সিজেন বন্ধ করে স্থানান্তর করা হয়নি। স্থানান্তরিত করার সময় সিলিন্ডার দিয়ে এবং ভেন্টিলেটরসহ সরানো হয়েছে।”
ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে স্বজনদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “এসব রোগীতো ভেন্টিলেটরে ছিল, তাদেরতো শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা ছিল। ধোঁয়ায় মৃত্যু হয়েছে বলে আপাতত মনে হয়নি।
“স্বজনরা বলতে পারেন, কারণ তারা এখন একটা মানসিক অবস্থায় আছেন। তবে তদন্ত করে ফাইনাল একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারব।”
দুই মাস আগেও ঢাকা মেডিকেলে একবার আগুন লেগেছিল, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, “আজকে যে আগুন, সেটা হাইফ্লো নেইজল ক্যানুলার ঘটনা হতে, আমরা তদন্ত করে দেখব।”
আইসিইউ ১০ নম্বর ওয়ার্ডে মাহমুদ মণ্ডল নামে এক রোগী ভর্তি ছিলেন। বুধবার সকালে সেখানে ছিলেন তার আত্মীয় ইসলামুল হক।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “১২ নম্বর আইসিইউতে ভর্তি রোগীর অ্যাটেনডেন্ট বলেছেন, হাইফ্লো নেইজল ক্যানুলায় আগুনের মত দেখে তিনি নেভানোর চেষ্টা করেছিলেন। তখন আনসারকে ডাকলে আনসার যায়নি। পরে আগুনটা ছড়িয়ে যায়, সেন্ট্রাল এসির মুখে আগুন লেগে যায়। সিস্টারদের ডাকলে আগুন দেখে তারা বের হয়ে যান।
“রোগীর স্বজনদের যার যার মত টেনে হিঁচড়ে বের করে আনার পর সিসিইউতে নেন। আগুন লাগার পর হাইফ্লু মেশিন নাকে লাগিয়ে কাঁধে নিয়ে বের হই মাহমুদ মণ্ডলকে। ভেতরে কোনো হুইল চেয়ার বা কিছুই ছিল না।”
ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, “কর্তৃপক্ষ বলছে, স্থানান্তরের পর মারা গেছেন। কিন্তু আমি ৯ নম্বর, ৮ নম্বর ও ১১ নম্বর আইসিইউর রোগীকে ভেতরেই মরতে দেখেছি।”
৯ নম্বর আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন কাজী গোলাম মোস্তফা, তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়ার উজানী গ্রামে, পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
তার ছেলে আজম বলেন, তার বাবার মুখমণ্ডল ধোঁয়ায় কালো ছিল।
হাসপাতাল পরিচালক বলেন, নতুন ১০ তলা ভবন ও পুরাতন বার্ন ইউনিটে বর্তমানে করনোভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। মঙ্গলবারের হিসাবে, ৫২৩ জন রোগী এখানে ভর্তি রয়েছেন।
“অগ্নিকাণ্ডের পর শুধু তৃতীয় তলার ওই অংশের রোগী সরানো হয়েছে। বাকি চিকিৎসা ব্যবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে।”
বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, আগুনে কক্ষটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো বিছানায় সকালের নাস্তায় চামচ রয়েছে। কোনো কোনো টেবিলে দেখা যায়, ওষুধের পুরো বাক্স পড়ে রয়েছে, ফ্লোরগুলোতে পানি রয়েছে।
যেখানে আগুন লাগে তার পাশেই পোস্ট সিসিইউ ওয়ার্ড। সেখানে কর্মরত একজন নার্স বলেন, এখানে ১৯ জন রোগী ছিল। আগুন লাগার পর তাদেরকেও অন্যত্র সরানো হয়েছে।