রাঙামাটি শহরে বেড়াতে আসা এক দম্পতির নৌকা রাঙামাটির হ্রদে ঝড়ে ডুবে যায় সাত বছর আগের এক মার্চে। তিন দিন পর তাদের মরদেহ পাওয়া যায় যখনও তারা পরম্পরকে জড়িয়ে রেখেছিলেন।
রাঙামাটি শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে জিরোমাইলে ডিসি বাংলোর ঠিক আগেই পলওয়েল নেচার পার্ক। পুলিশের উদ্যোগে নির্মিত এই পার্কের ভেতরে নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজনের ভিড় পেরিয়ে একেবারে শেষ প্রান্তে রয়েছে এক বৃক্ষ, যেখানে এসে সবাই থমকে দাঁড়ায়- এর নামই ‘লাভ পয়েন্ট’।
সেখানে ভালোবাসার একটি স্মারকস্তম্ভে ঝুলছে শত শত তালা; প্রতিটি তালাতেই লেখা দুটি নাম! বন্ধ তালাগুলোর চাবি নেই কোথাও! এর উত্তর পাওয়া যায় পাশেই স্থাপিত ‘ভালোবাসার শোকগাথায়’, যেখানে লেখা আছে এই স্থাপনার পেছনের মর্মন্তুদ ঘটনা। এই ঘটনার কথা পড়তে গিয়ে চোখ ভিজে আসে এখানে বেড়াতে আসা অনেকের।
২০১৪ সালের ১৯ মার্চের সেই ঘটনা
ওইদিন ঝড়ের কবলে পড়ে এক দম্পতির কাপ্তাই লেকে নিখোঁজ হওয়ার খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আলাউদ্দিন পাটোয়ারী দেশে এসে স্ত্রী আইরিন সুলতানা লিমাকে নিয়ে রাঙামাটি বেড়াতে এসেছিলেন। ট্রলারে করে তারা কাপ্তাই হ্রদে নৌভ্রমণে গিয়েছেলেন।
বিকালে পর্যটন কমপ্লেক্সে ফেরার পথে হ্রদের মাঝখানে থাকা আদার পাহাড় এলাকায় আকস্মিক কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে ইঞ্জিন বোটটি ডুবে যায়। স্বামী-স্ত্রী নিখোঁজ হন।
পরে নৌবাহিনীর ডুবুরিরা এসে বোটসহ চালক বিটন চাকমাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন; কিন্তু নিখোঁজ দম্পতির সন্ধান তখন মেলেনি।
তিন দিন পর ২২ মার্চ হ্রদে তাদের লাশ পাওয়া যায়। রাঙামাটি কোতোয়ালি থানার ওসি সোহেল ইমতিয়াজ সেদিন জানান, দুর্ঘটনাস্থল আদার পাহাড় এলাকাতেই তাদের লাশ দুটি ভেসে ওঠে।
কাপ্তাই লেকে নিখোঁজ দম্পতির লাশ উদ্ধার
কাপ্তাই হ্রদে নৌকাডুবি, পর্যটক স্বামী-স্ত্রী নিখোঁজ
স্থানীয় সাংবাদিক হেফাজত সবুজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই ঘটনার কিছুদিন পর রাঙামাটিতে একটি সেমিনার হয়। সেখানে এই দম্পতিসহ পৃথিবীর সবার ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঘটনাস্থলের পাশে একটি ‘লাভ লক পয়েন্ট’ নির্মাণের প্রস্তাব করেন সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপনকারী এক তরুণ সংবাদকর্মী।
“তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে ‘লাভলক পয়েন্ট’ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন সভার প্রধান অতিথি সেই সময় পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। তিনি রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অনুরোধ করেন।”
লাভ পয়েন্ট হয়েছিল যেভাবে
হেফাজত সবুজ জানান, নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার অনুরোধে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ শহরের ‘পলওয়েল পার্কে’ লাভ পয়েন্টের ভিত্তি প্রস্তরও স্থাপন করা হয়। কিন্তু পার্বত্য মন্ত্রণালয় সচিব থেকে নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা চলে যাওয়ার পর জেলা পরিষদ আর প্রকল্পটি নিয়ে এগোয়নি।
পরে নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেলে উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নেই পলওয়েল পার্কের কাজ শুরু করেন বলে জানান সবুজ।
পলওয়েল পার্কে নির্মিত ‘লাভ পয়েন্ট’-এ প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারী-পুরুষ আসেন।
সেখানে একটি হৃদয় আকৃতির ‘লাভ সাইন’ স্থাপন করা হয়েছে, যাতে প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার মানুষের নাম লেখা তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তালার চাবি ফেলে দেওয়া হয় কাপ্তাই হ্রদে।
পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে নদী বা হ্রদের ধারে, সেতুতে কিংবা উঁচু জায়গায় এরকম ‘লাভ লক পয়েন্ট’ তৈরি হয়েছে, যেখানে প্রেমিক জুটিরা তাদের নাম লিখে তালা বন্ধ করে চাবি ফেলে দেন পানিতে।
ধারণাটা এরকম- চাবি ফেলে দেওয়ায় এ তালা আর খোলা যাবে না, প্রেমের বন্ধনও আর ছিন্ন হবে না কখনো।
রাঙামাটির ‘লাভ পয়েন্ট’ হয়েছে যাদের স্মরণে, সেই আলাউদ্দিন-লিমা দম্পতির প্রতি ভালোবাসার স্মারক হিসেবে তাদের ‘ভালোবাসার শোকগাথা’য় লেখা আছে পুরো ঘটনার বিবরণ । এই বিবরণ থেকে পর্যটকরা এই স্থাপনা নির্মাণের কাহিনী জানতে পারেন।
২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর ‘লাভলক পয়েন্ট’ উদ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা।
ওইদিন সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান তরুণ কান্তি ঘোষ, রাঙামাটি পুলিশ সুপার আলমগীর কবিরসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
‘লাভ পয়েন্ট’ উদ্বোধনের পর নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা ও তার স্ত্রী অনামিকা ত্রিপুরা লাভ পয়েন্টে তালা লাগিয়ে চাবি কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ছুড়ে ফেলে ‘লাভ লক’ এর সূচনা করেন।
এখন এই লাভ লক পয়েন্টের কাঠামোতে কয়েকশ তালা ঝোলানো আছে, যাতে লেখা রয়েছে প্রেমিক যুগলের নাম।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক অনন্যা জয়িতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ইউটিউবে একটি ভিডিও দেখেছি এ সম্পর্কে। তখন থেকেই আসার পরিকল্পনা ছিল; আসলাম, দেখলাম। মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেল। স্বামী-স্ত্রীর এমনভাবে বাঁচার চেষ্টা এবং মর্মান্তিক মৃত্যু মর্মস্পর্শী।”
‘লাভ পয়েন্ট’ উদ্বোধনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেছিলেন, “পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের স্মারক থাকলেও বাংলাদেশে এটাই প্রথম। এর মাধ্যমে নিহত দম্পতির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পাশাপাশি পৃথিবীর সব ভালোবাসাকেও স্মরণ করতে চেয়েছি আমরা। একই সাথে পর্যটন শহর হিসেবে এই শহরে বেড়াতে আসা পর্যটকদের প্রতি ভালোবাসাটাও দেখাতে চেয়েছি।”