ক্যাটাগরি

ধ্বংসস্তূপে বসেই বঙ্গবন্ধু সাজালেন ‘সোনার বাংলার’ পরিকল্পনা: সৈয়দ আনোয়ার

ঘাতকের হাতে
প্রাণ দেওয়ার আগে যে চার বছর সময় তিনি পেয়েছিলেন, সেই সময়ের মধ্যেই নবগঠিত দেশকে মর্যাদার
আসনে নিয়ে যাওয়ার বড় কাজগুলো শুরু করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

তার সেই বাংলাদেশ
স্বাধীনতার অর্ধশতকে এসে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি পেয়েছে,
যখন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারই মেয়ে শেখ হাসিনা।

স্বাধীনতার
সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে ১০ দিনের
অনুষ্ঠানমালার পঞ্চম দিন রোববারের অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘ধ্বংসস্তূপে জীবনের জয়গান’।

বিকাল ৫টায়
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে থিমভিত্তিক আলোচনায় বক্তৃতা করেন ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন,
“১৯৭২ সালেও যে দেশটি স্বীকৃতি ও বন্ধুহীন ছিল, সেই দেশটিকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার
আগেই একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু।”

সেই সময়ের
বাংলাদেশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজের কথা, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতামত এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক
প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ বক্তৃতায় হাজির করেন অধ্যাপক আনোয়ার।

১৯৭১ সালের
১৬ ডিসেম্বর বাঙালি যখন মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় পেল, বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের
কারাগারে বন্দি। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান তাকে মুক্তি দিলে ১০ জানুয়ারি লন্ডন
ও ভারত হয়ে দেশে ফেরেন জাতির পিতা।

সে সময় লন্ডনে
এক সংবাদ সম্মেলনে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ নিয়ে এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার মাটি ও মানুষ যদি থাকে, আমি আবার উঠে দাঁড়াব।”

১৯৭৬ সালে
বাংলাদেশ নিয়ে লেখা বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বই ‘বাংলাদেশ: দ্য টেস্ট কেইস অব ডেভেলপমেন্ট’
থেকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, “তারা বলেছিলেন বাংলাদেশের উন্নয়ন পৃথিবীর কঠিনতম
সমস্যা। বাংলাদেশে যদি উন্নয়ন হয়, তাহলে পৃথিবীর সব দেশে উন্নয়ন হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন
করতে অন্তত দুইশ বছর লাগবে। এই বাংলাদেশ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার মাটি আর মানুষ দিয়েই
বঙ্গবন্ধুর যাত্রা শুরু হয়েছিল।”

১৯৭২ এর ২৬
মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, “আজ আমাদের সামনে পর্বততুল্য
সমস্যা উপস্থিত। মহাসঙ্কটের ক্রান্তি লগ্নে আমরা উপস্থিত হয়েছি। বিদেশ ফেরত এক কোটি
উদ্বাস্তু। স্বদেশের বুকে দুই কোটি গৃহহারা মানুষ। বিধ্বস্ত কর্মহীন চট্টগ্রাম পোতাশ্রয়,
নিশ্চল কারখানা, নির্বাপিত বিদ্যুৎ সরবরাহ, অসংখ্য বেকার, অপরিমিত অরাজকতা, বিশৃঙ্খল
বাণিজ্যিক সরবরাহ ব্যবস্থা, ভগ্ন সড়ক-সেতু, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা। দারিদ্র্য,
খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি এবং অকর্ষিত ভূমি- এই সবকিছুই আমরা পেয়েছি উত্তরাধিকার
সূত্রে।

“জনগণের গভীর
ভালোবাসা, আস্থা, অদম্য সাহস ও অতুলনীয় ঐক্যকে সঙ্গী করে আমার সরকার এই সঙ্কটকে কাটিয়ে
উঠার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে।”

সে সময় অর্থনীতি
পুনরুদ্ধার এবং মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানই যে বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনিক তৎপরতার মূল
বিষয়বস্তু ছিল, তা তুলে ধরতে গিয়ে ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধুর
ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করেন সৈয়দ আনোয়ার।

বঙ্গবন্ধু
বলেছিলেন- রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায় যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি
দুঃখী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়,
তাহলে মানুষের জীবনের শান্তি ফিরে আসতে পারে না।

১৯৭২ সালের
৯ মে রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধুর এক ভাষণ থেকে তুলে ধরে অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, “আমি চাই বাংলার
মানুষ পেট ভরে খাক, আমার বেকার মানুষ কাজ পাক, আমার বাংলার মানুষ হেসে-খেলে বেড়াক।
আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক।”

বঙ্গবন্ধুর
উদ্যোগগুলো বিশ্লেষণ করে এই অধ্যাপক বলেন, “অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনের সূচনা হয়েছিল মাত্র
৯ মাসের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। অথচ সংবিধান প্রণয়নে পাকিস্তানের সময়
লেগেছিল ১০ বছর।

সম্পদের চরম
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের গতি ছিল সন্তোষজনক। স্বাধীন বাংলাদেশের
উপযোগী করে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্যে কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশন গঠন ও প্রাথমিক
বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়, ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। শিক্ষা
খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল অন্যতম। ৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের
স্বায়ত্ত্বশাসন নিশ্চিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

“তখন বাংলাদেশের
সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি। সেজন্য বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারির
ভাষণে এক দিকে স্বীকৃতির আবেদন জানিয়েছেন, অন্যদিকে ঋণ সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন করেছেন।
১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টের মধ্যে ১৩৪টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। চীন, সৌদি আরব,
জর্ডান, ইরাক স্বীকৃতি না দিলেও এইসব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রস্তুতি
পর্ব বঙ্গবন্ধুর আমলেই শেষ হয়েছিল।”

১৯৭৪ সালের
২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য হয়। তার আগের দিন পাকিস্তান স্বীকৃতি দিয়েছিল।
সেদিন লাহোর বিমানবন্দরে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ে।

জীবনের শেষ
লগ্নে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত শাসন ব্যবস্থা বাকশালের মূল্যায়ন
করে অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, “বঙ্গবন্ধুর বাকশাল ২৩৩ দিন কার্যকর ছিল। এই সময় সব সূচকে
সন্তোষজনক অগ্রগতি ছিল। সিআইএ-এর দলিলেও তা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রবৃদ্ধির
হার ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।

“সিস্টেম
পরিবর্তন করেছিলেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্য।
কিন্তু নতুন সিস্টেমে মানুষ হাসার আগেই বঙ্গবন্ধুর হাসি বিদায় নিয়েছিল চিরতরে। কিন্তু
তিনি বাংলাদেশকে প্রগতির পথে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন।”