ক্যাটাগরি

অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ বঙ্গবন্ধুই চিনিয়েছেন: সেলিনা হোসেন

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে ১০ দিনের অনুষ্ঠানমালার ষষ্ঠ দিন সোমবারের ‘বাংলার মাটি আমার মাটি’ শিরোনামের আলোচনায় একথা বলেন তিনি।

সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর ‘বাংলার মাটি, আমার মাটি’ চিন্তা তার জীবনের মৌলিক সত্যের দর্শন। এই শব্দটিকে তিনি নিরন্তর সাধনায় সমৃদ্ধ করেছেন- এটা কোনো স্লোগান ছিল না। তিনি গভীর বিশ্বাসে নিজের জাতিসত্ত্বাকে ধারণ করে এই কথাটি বলেছেন।

“বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আজ আমি বলতে পারি আমি বাঙালি, আজ আমি বলতে পারি বাঙালি একটি জাতি, আজ আমি বলতে পারি বাংলার মাটি আমার মাটি। এর বেশি তো আমি চাই নাই।”

এই  কথাসাহিত্যিক বলেন, “দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তিনি মানতে পারেননি। এমনকি তিনি পূর্ব পাকিস্তান নামটিও মানতে পারেননি।”

“১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ হওয়ায় ইতিহাসের বঙ্গের পূর্বাঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান হয়। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ব বাংলা বলার পক্ষে সরব ছিলেন।”

এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন সময়ে দেওয়ার বক্তব্যের প্রসঙ্গ টানেন সেলিনা।

“বাংলা শুধু একটি শব্দ ছিল না, ছিল জীবন দর্শনসহ জাতিসত্ত্বার পরিচয়। মানুষ হিসাবে পরিচয়ের পরে প্রতিটি মানুষকে জাতিসত্ত্বার পরিচয়ের সত্য ধারণ করতে হয়- তিনি এই বিশ্বাস প্রতিটি মানুষের রন্ধ্রে ঢুকিয়েছেন।”

১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সেলিনা বলেন, “একটি বিশেষাধিকারের প্রশ্নে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। পাকিস্তান গণপরিষদের কার্যপ্রণালি বিধি ২৯ এর অধীনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যে সংসদের সরকারি ভাষা হচ্ছে তিনটি। ইংরেজি বাংলা ও উর্দু।

“কিন্তু মহোদয় আপনি জানেন যে, দিনের আলোচ্যসূচি ইংরেজি ও উর্দুতে বিতরণ করা হয়, বাংলায় করা হয় না। বিষয়টি আপনি অবগত আছেন কিনা কিংবা এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে কিনা আমি জানি না।…. যদি দিনের আলোচ্যসূচি ইংরেজি ও উর্দুতে প্রচার করা হয় তাহলে অবশ্যই বাংলাতেও করতে হবে।”

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উদ্ধৃত করে সেলিনা বলেন, “জেলখানায় আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল, আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম; বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান।

“একবার মরে, দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আইসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব। আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করা যাবে না। তোমাদের কাছে ক্ষমতা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব। জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটিই আমার স্থান।”

বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যে অসাম্প্রদায়িক বাংলার ভিত্তি পাওয়ার যায় বলে মন্তব্য করে সেলিনা হোসেন বলেন, “এই রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ থাকবে না। এই রাষ্ট্র মানুষেরই হবে, তাদের মূলমন্ত্র হবে সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই। বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নাই।

“মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন তারা সকলেই এদেশের নাগরিক। সকল ক্ষেত্রে তারা সমঅধিকার ভোগ করবেন। এভাবেই বাঙালির মর্যাদার স্থান প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। বাঙালির আত্মপরিচয়ের সীমানা নির্ধারণ করে দিয়ে ইতিহাসের গৌড় বঙ্গকে বাংলাদেশ করে বিশ্বের কাছে বাঙালির পরিচয়কে সার্বভৌমত্ব দিয়েছেন।”

পল্টন ময়দানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বলেছিলেন, ভুলে যেও না এই বাংলা তিতুমীরের বাংলা, ভুলে যেও না এই বাংলা সূর্যসেনের বাংলা, ভুলে যেও না এই বাংলা নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের বাংলা, ভুলে যেও না এই বাংলা ফজলুল হকের বাংলা, ভুলে যেও না এই বাংলা সোহরাওয়ার্দীর বাংলা। এই বাংলা যেমন পলিমাটির বাংলা। চৌত্র মাসের প্রখর রৌদ্রের সময় এই বাংলার মাটি এমন শক্ত হয়ে যায়, যার আঘাতে অনেকের মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।“

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঞ্চালনায় ষষ্ঠ দিনের অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও এদিনের আলোচনায় অংশ নেন।