তিনি
বলেছেন, “একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি আমরা প্রথমে কূটনৈতিকভাবে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরার চেষ্ট করছি, যাতে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক
গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব করা হলে কেউ আপত্তি জানিয়ে সেই প্রস্তাব বাতিল করতে না পারে।”
বৃহস্পতিবার
জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত গণহত্যা দিবসের আলোচনা সভায় এ কথা বলেন
মন্ত্রী।
বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে
এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান; শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ
পর্ব।
নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি
এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত
হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
সেই বাংলাদেশ শুক্রবার স্বাধীনতার
সুবর্ণজয়ন্তীতে পৌঁছাচ্ছে, আর তার আগে
বৃহস্পতিবার পূর্ণ হল ২৫ মার্চের সেই কালরাতের ৫০ বছর।
২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ
দিনটি গণহত্যা দিবস
হিসেবে পালন করে এলেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি এখনও পূরণ হয়নি।
মোজাম্মেল
হক বলেন, “জাতিসংঘের মাধ্যমে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক
গণহত্যা দিবস পালন করা হয়। তার পেছনে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নাই। এটা পালন করতে হবে, তাই তারা সুবিধামত ৯ ডিসেম্বর পালন
করছে।
২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দিল সংসদ
“আমরা
জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশনে সংশোধন দাবি করেছি। প্রথমত আমরা জাতীয় সংসদের স্বীকৃতির মাধ্যমে ২৫ মার্চকে রাষ্ট্রীয়ভাবে
জাতীয় গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছি। এখন আমরা জাতিসংঘের মাধ্যমে ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে
২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক
গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করছি, যেমনিভাবে আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।”
গণহত্যার
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য ব্যাপক গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও ‘গণহত্যার আর্কাইভ’
করার পরামর্শ দেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
সেই
পরামর্শে সম্মতি জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, “আমরা এতদিন মৌখিকভাবে স্বীকৃতির জন্য দাবি জানিয়েছি। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি দিয়ে
তাদেরকে বিষয়টি বোঝাতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করব, আরও ব্যাপকভাবে বইপত্র, তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে সারাবিশ্বে গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরতে। আমরা একাত্তরের আর্কাইভও
করতে চাই। বিভিন্ন ভাষায় সেগুলো সংরক্ষণ করা হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারবে। সরকার যাতে আরও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে, সে ব্যাপারে আমার
আন্তরিক প্রচেষ্ট থাকবে।”
মুক্তিযুদ্ধের
স্মৃতি সংরক্ষণে সারাদেশের জাদুঘরগুলোকে ‘স্বাধীন সত্তা’ দিয়ে সরকারি অর্থায়নে পরিচালনার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, “কেন্দ্রীয় জাদুঘর যেভাবে চলছে, তেমনিভাবে সারাদেশে জাদুঘরগুলোকে পরিচালিত করতে হবে। একটা মানদণ্ডে বাছাই করে জাদুঘরগলোর স্বীকৃতি দিয়ে ম্যানেজমেন্টর জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে খরচ বহন করতে হবে। সত্যিকার ইতিহাস চর্চার জন্য এটা খুবই দরকার। আগামী বছরের মধ্যেই যাতে আমরা বলতে পারি, এতগুলো জাদুঘর আমরা পুষ্ঠপোষকতা করছি। সরকার যদি করতে না চায়, বিকল্প
ব্যবস্থা হলেও আমরা এটা করব। এইটুকু আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারি।”
মুক্তিযুদ্ধের
চেতনায় ভবিষ্যত প্রজন্মকে গড়ে তুলতে নানা পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা বধ্যভূমি সংরক্ষণ, ফলক তৈরি, ঐতিহাসিক স্থান, গণ কবর সংরক্ষণ,
ব্যাপক গবেষণা, মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্ত কবর একই ডিজাইনে করার পরিকল্পনা করছি। ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে এগুলো দেখে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে।”
আলোচনা
সভায় সাবেক নৌ-মন্ত্রী ও
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান বলেন, “স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসেও আমাদের দেশের অনেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করেতে পারেনি, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। আমাদের দেশে জঙ্গি তৈরির জন্য মগজধোলাইয়ের ব্যবস্থা আাছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মগজধোলাইয়ের ব্যবস্থা নাই।”
আলোচনা
সভা থেকে তিনি ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা
দিবস পালন এবং একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ‘ক্ষমা চাইতে বাধ্য করার’ জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
আলোচনা
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, “আমরা প্রথম থেকে বিজয়কে গুরুত্ব দিয়েছি। তাই গণহত্যা, নির্যাতন আড়ালে পড়ে গেছে। গণহত্যার সংখ্যা নিয়েও রাজনীতি হয়েছে।
“আমরা
একটি জরিপে দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এদেশের মানুষের উপর ৪৮ রকমের নির্যাতন
চালিয়েছে তারা। এগুলো আমরা তুলে ধরিনি। বলা হচ্ছে, দুই লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন-ধর্ষণ করেছে। আমি যে গবেষণা করেছি,
সেখানে ৫ লক্ষেরও বেশি
ধর্ষণের ঘটনা পাওয়া গেছে। হাই কোর্ট আমার গবেষণাটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধ
জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন।